নির্বাচনী ঝড়ের কবলে পুরো দেশ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী সংলাপ শুরু হচ্ছে আগামীকাল থেকে। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিষ্ঠিত জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের মতামত নেওয়ার মধ্য দিয়ে সংলাপের পর্ব শুরু হচ্ছে। দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে পরিচিত এ নাগরিকদের মতামত নেওয়া শেষে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসবে ইসি। নির্বাচন ইস্যুতে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনো রয়েছে দুই মেরুতে। এই দুই দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের সংলাপের এই উদ্যোগ কতখানি কার্যকর হবে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রশ্নমুক্ত করতে সম্প্রতি রোডম্যাপ ঘোষণা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন। রোডম্যাপ অনুযায়ী, আগামীকাল সুশীল সমাজ, এরপর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং সবশেষে নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। ঘোষিত রোডম্যাপে অবশ্য নারীদের সঙ্গে সংলাপ ছিল না। অতিসম্প্রতি এটি যোগ করা হয়েছে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ইসির আমন্ত্রিত ৬০ নাগরিক সাত কর্মপরিকল্পনার আলোকে কালকের সংলাপে মতামত দেবেন। নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহর ভাষ্যমতে, সাত কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী আইনি কাঠামোগুলো পর্যালোচনা ও সংস্কার, রোডম্যাপের ওপর পরার্মশ গ্রহণ, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, জাতীয় পরচিয়পত্র প্রস্তুত ও বিতরণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ।
জানা গেছে, আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই সংলাপে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কোন কোন বিষয়ে কথা বলবেন তার একটা তালিকা তৈরি করছেন। অনেকে আবার গা ছেড়ে বসে আছেন। বলছেন, আগে কমিশনে যাই, পরিস্থিতি বুঝি, তার পর দেখি কী বলা যায়। কয়েকজন আবার জানালেন, ইসির সংলাপে অংশ নেওয়া আসলে উলুবনে মুক্তা ছড়ানো ছাড়া কিছুই নয়। তার পরও কেন যাচ্ছেন? আমাদের সময়ের এমন প্রশ্নে জানালেন, যেতে হয় তাই যাচ্ছি। এ ছাড়া কমিশনের আমন্ত্রিত অতিথির তালিকায় নাম রয়েছে কিন্তু আমন্ত্রণপত্র পাননি এমন নাগরিকের খোঁজও পাওয়া গেছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা ইসির সংলাপের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।
সংলাপে আমন্ত্রিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কমিশনের সঙ্গে সংলাপে যেতে পারি। যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কী বিষয়ে আলাপ করবেন জানতে চাইলে বলেন, এ বিষয়ে আগাম কথা বলতে চাই না। আগে ওখানে যাই, গিয়ে দেখি…। সেখানকার প্রশ্নের ধরন কেমন তার ওপর বিষয়টি নির্ভর করবে।
তত্ত্বাবধায় সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন আমন্ত্রণপত্রে বেশকিছু আলোচ্যসূচির কথা জানিয়েছে। আমি এখনো চূড়ান্ত করিনি কোন কোন বিষয়ের ওপর কথা বলব। এটা যাওয়ার আগ মুহূর্তে ঠিক করব। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, আমার মনে হয় না আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে। তাই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া উলুবনে মুক্তা ছড়ানো একই কথা। উলুবনে মুক্তা ছড়াতে কেন যাবেন? এমন প্রশ্নে বলেন, কিছু পরামর্শ দিতে যাব আমি। যেমন সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, নির্বাচনে যাতে সব দলের জন্য সমান সুযোগ থাকে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে এই বিষয়ে আমি বক্তব্য তুলে ধরব।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, কমিশন যে সাত দফা কর্মপরিকল্পনা করেছে এর সঙ্গে আরও দুটি কর্মপরিকল্পনা যোগ করার আহ্বান জানাব। একটা হচ্ছে, নির্বাচনের সময় সহিংসতা ও নির্বাচনপরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। এ ছাড়া নির্বাচনের বিষয়ে যেন প্রতি ৫ বছর পর সংলাপে বসতে না হয়, একটা স্থায়ী সমাধান কীভাবে করা যায় সে লক্ষ্যেও কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করব।
ইসির আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় নাম থাকলেও গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত আমন্ত্রণপত্র পাননি বলে জানিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির এবং ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। নির্বাচন কমিশনের সংলাপের আমন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দুজনই বেশ অবাক হন। তারা কোনো আমন্ত্রণপত্র পাননি বলে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিষ্ঠিত নাগরিকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সরকারি দল আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা। তাদের মতে, এ উদ্যোগের ফলে নির্বাচনের বিষয়ে সবাই তাদের মতামত জানাতে পারবেন। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, নির্বাচন কমিশনের সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে, এটা একটা ভালো দিক। এতে সবাই তাদের নিজ নিজ ভাবনা তুলে ধরতে পারবে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন বসবে বলে আমরা শুনেছি। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি এখনো। আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর পর আমাদের অবস্থান কী হবে, সেটা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ঠিক করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সংবিধানেই বাইরে যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনের পক্ষে মত দিবে দল।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠনসহ নির্বাচন প্রক্রিয়া কী ধরনের হওয়া উচিত তার একটি রূপরেখা জমা দিয়েছে। তার ভিত্তিতে সংলাপে আলোচনা করবে দল। তবে বিএনপি মনে করে, নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক হওয়ার পর আলোচনা করলে তা ফলপ্রসূ হতো। দলের নেতারা বলেন, এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা স্পষ্ট করা। সেটি না করে সংলাপ করলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি হবে না।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, তারা সংলাপে যাবেন, এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে, সে বিষয়ে দেশে সংকট আছে। আগে এ সংকটের সমাধান করতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া ঠিক না করে নির্বাচন কেমন হবে সে বিষয়ে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফিরে সহায়ক সরকারের প্রস্তাব তুলে ধরবেন। সেখানে তিনি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব থাকবে বলে জানা গেছে।
সূত্র: আমাদের সময়