‘পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ়’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তায়নে বাংলাদেশসহ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) সহায়তা কামনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে আইএইএ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে বাংলাদেশের কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থানের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন। খবর-বাসস।
মঙ্গলবার অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় আইএইএ’র এক সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ আইএইএ’র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে চায় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষে কাজ করতে আগ্রহী। এসডিজি বাস্তবায়নে বিশেষকরে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় আইএইএ’র প্রয়াস জোরদারে গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, এসডিজি অর্জনে সক্ষমতা গড়ে তোলা ও প্রযুক্তি স্থানান্তর খুবই প্রয়োজন। আইএইএ’র ৬০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সংস্থাটি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ‘আইএইএ কারিগরি সহযোগিতা কর্মসূচির ৬০ বছর পেরিয়ে: উন্নয়নে অবদান’ শীর্ষক তিন দিনের এই সম্মেলনের আয়োজন করে।
শেখ হাসিনা কারিগরি সহযোগিতার জন্য সংস্থাটির সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। আইএইএ’র মহা পরিচালক ইউকিয়া আমানো, মরিশাসের প্রেসিডেন্ট আমেনাহ গারিব-ফাকিম উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট তাবেরে ভাজকুয়েজ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। শেখ হাসিনা শান্তি ও উন্নয়নে পরমাণুর ব্যবহার নিশ্চিত করতে ৬০ বছরের অব্যাহত প্রয়াসের জন্য আইএইএ’র ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি বিগত ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নে সমর্থন দেয়ার জন্যও সংস্থাটিকে ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পরপরই আইএইএ বাংলাদেশকে সদস্য পদ প্রদান করে। আইএইএতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন তাঁর স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সংস্থাটির সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সংযোগের কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তাঁর (ওয়াজেদ মিয়া) দৃঢ় ও দূরদর্শী পদক্ষেপ শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের রূপায়নের সহায়ক হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্র (এইআরসি) ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা, রেডিয়োআইসোটপ উৎপাদন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নানা আবিষ্কার বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের পাটের জেনেটিক কোডের পাঠোদ্ধার একটি বিরাট সাফল্য এবং জ্ঞানের চর্চা ও বিনিময়ের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ‘সায়েন্স ডিপ্লোম্যাসি’ গ্রহণ করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জনের জন্য আমাদের লক্ষ্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনার পরিপূর্ণ ব্যবহার। ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সরকার কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন খাতের সমস্যা সমাধানের ওপর জোর গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আইএইএ’র সাথে চমৎকার সহযোগিতা উপভোগ করছে এবং কারিগরি সহযোগিতায় প্রায় ১৩৮টি জাতীয় প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং রিজিওনাল কো-অপারেটিভ এগ্রিমেন্টের (আরসিএ) অধীনে ১১১টি আঞ্চলিক প্রকল্পে অংশ নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আইএইএ’র কারিগরি সহযোগিতা কার্যক্রমের কাঠামোর আওতায় পরমাণু শিক্ষা ও গবেষণা, খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন, পানিতে আইসোটোপ কৌশল প্রয়োগ, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, নন ডেস্ট্রাকটিভ টেস্টিংয়ের মতো শিল্প সহায়তা, শস্য ও গবাদি পশুর উন্নয়ন এবং পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের মতো অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সহযোগিতা পেয়েছে।
তবে দুইটি ক্ষেত্রে সাফল্যকে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার বিনার উচ্চফলনশীল জাত ও লবণাক্ত সহিষ্ণু শস্য জাতের উন্নয়ন ও উদ্ভাবন এবং দেশে নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেবায় অগ্রগতিকে অসামান্য অর্জনের কথা তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিনা ইতোমধ্যেই ৯২টি শস্য প্রজাতির উন্নয়ন ঘটিয়েছে এর মধ্যে ১৩টির উন্নয়নে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি, বিকিরণ এবং অন্যান্য অগ্রসর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব শস্য উচ্চ ফলনশীল, উচ্চ পুষ্টিমান, স্বল্প সময়ে ফলন, লবণাক্ততা ও বন্যা সহিষ্ণু এবং জলবায়ু পরিবেশ সহিষ্ণু।বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে অবদান রাখার জন্য এফএও- আইএইএ কর্তৃক ‘বিনা’-কে ২০১৪ সালে ‘আউটস্ট্যান্ডিং অ্যাচিভমেন্ট এওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়। তিনি বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বনির্ভর এবং এমনকি অতিরিক্ত খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে সক্ষম।’বাংলাদেশে পরমাণু চিকিৎসা সেবার অগ্রগতি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে পরমাণু চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারণ এবং শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি, গত বিশ বছরে রোগ নির্ণয় করে চিকিসৎসা করতে সক্ষম লোকের সংখ্যা ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে পনেরটি সরকারি এবং ছয়টি বেসরকারি নিউক্লিয়ার মেডিসিন ইনস্টিটিউট প্রতিবছর চার লাখেরও বেশি রোগীকে নিউক্লিয়ার মেডিসিনের মাধ্যেমে চিকিৎসা দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অতি সম্প্রতি ক্যানসারের চিকিৎসায় আধুনিক পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহার জনগণকে প্রকৃত সাহায্য করছে।
পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের পদক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পারমাণবিক শক্তিকে আমরা নিরাপদ, পরিবেশ-বান্ধব এবং অর্থনৈতিকভাবে বিদ্যুতের সবচেয়ে টেকসই উৎস হিসাবে বিবেচনা করি।’ তিনি বলেন, রাশিয়ার সহায়তায় নির্মীয়মান রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দু’টি রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উদপাদন করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সাল নাগাদ পারমাণবিক উৎস থেকে চারহাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করবে এবং এভাবে বর্ধিত উৎপাদনশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্ভাবনাকে প্রসারিত করবে।