পুরুষতন্ত্রের নীরব শিকার পুরুষ স্বয়ং-ফাহমি ইলা
ইদানিং অহরহ পুরুষসহকর্মী/পুরুষট্রেইনি/পুরুষবন্ধুটির কাছ থেকে একটি প্রশ্ন তীরের বেগে ছুটে আসে-‘শুধুই কী নারীরা নির্যাতিত? আমরাও কি যন্ত্রণায় নেই? আমাদেরও কি কষ্ট নেই?’ আসলেইতো! বিষয়টি ভাবনার খোরাক যোগায়, কীভাবে একজন পুরুষ কষ্ট পান কিংবা যন্ত্রণা ভোগ করেন? চলুন, পুরুষের কথায় উঠে আসা তাদের কয়েকটি যন্ত্রণার ধরণ দেখি।
এক-‘আমি ছোটবেলায় আমার বড়বোনের নেওটা ছিলাম। তার সাথে খেলতে ভালো লাগতো। কিন্তু ঘরে তার সাথে হাড়িপাতিল, পুতুল নিয়ে বসলে মা-খালারা তেড়ে আসতো। ‘বেইট্যা পোলা হইছে!’ ‘মাইয়া নাকি তুই?’ এরকম তিরষ্কার শুনতে হত। আমি মাঠে খেলতে যেতে চাইতাম না কারণ বয়সের তুলনায় ছোটখাটো ছিলাম বলে অন্যান্য ছেলেরা হাসিতামশা করতো, খেলায় নিত না। আর ঘরে বসে থাকলে মা-বাবা তাগাদা দিতো বাইরে যেতে। অথচ আমার ছোটবোনটি বাইরে যেতে চাইলে তাকে বাইরে যেতে দিত না। এখনো আমার ঘরে বসে বই পড়তে ভালো লাগে, অফিস থেকে ফিরে টুকটাক ঘরের কাজ করতে ভালো লাগে। আমার বৌ মেনে নিলেও ও অনুরোধ করেছে বাসায় মেহমান এলে যেনো এ কাজগুলো না করি। এতে বলে মানুষ কটাক্ষ করবে, হাসবে। আমার বৌকে পাশের বাসার কোন ভাবী নাকি তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছে- ‘আপা, ভাই বোধহয় আপনাকে অনেক সাহায্য করে! এত বৌনেওটা!’ এই যে এ কথাগুলো এগুলো আমার ওপর স্পষ্ট মানসিক টর্চার। এটা বহু ছেলেই সহ্য করে!’
দুই-‘ছোটবেলা থেকে যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকে একটাই কথা শুনেছি-‘ছেলে আমার বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে’। আমার তিনটা বোন। প্রত্যেককে বাবা ইন্টার পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ছোটবোন পড়াশোনা করতে চেয়েছিলো কিন্তু বাবার ধমকে চুপ মেরে গেছিলাম সবাই। আমি মাস্টার্স শেষ করলাম, চাকুরিতে ঢুকলাম। বিয়ে হলো বাবা-মার পছন্দেই। আমি খুব ভ্রমণপিপাসু মানুষ। মনে মনে চেয়েছিলাম এমন একজন জীবনসঙ্গী যে আমার জীবনপথে আসলেই সঙ্গী হবে। কিন্তু সে টিপিক্যাল হাউজওয়াইফ হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। তাকে চাকরির ব্যাপারে কিছু বললে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে তার ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার। বাবার সংসার আর নিজের সংসার টানতে টানতে আমার ভ্রমণপিপাসু মন মরে গেছে। স্রেফ একটা দাসে পরিণত হয়েছি!’
তিন-‘দেখতেই পাচ্ছেন আমি ছোটখাটো মানুষ। গায়ের রঙ সাদা এবং লম্বায় ছোটখাটো এবং শুকনো হবার কারণে সবসময় ‘হাফলেডিস’ শব্দটা শুনতে হয়েছে। আমার পুরুষালী মাসল নেই, আমি রুক্ষ না, আমার কণ্ঠস্বর হরমোনাল কারণে চিকণ। এজন্য মেয়েরা পর্যন্ত কাছে ঘেঁষে না। আর ছেলেরা যা বলে তা সরাসরি বলতে পারছি না। শুধুমাত্র শারীরিক গঠনের জন্যও যে একজন মানুষ ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে না তা জন্ম না নিলে কিভাবে বুঝতাম!’ আমি বিশ্বাস করি- সমাজে পিতৃতন্ত্রের ধারক যেমন শুধু পুরুষ না, তেমনি পিতৃতন্ত্রের দ্বারা নির্যাতিত শুধু নারীও না। এ তন্ত্র/বাদ/ইজম পুরুষকে উর্ধ্বে তুলে নারীকে অধঃ করেছে, নারীকে করেছে নির্ভরশীল। কিন্তু পুরুষকে উর্ধ্বে স্বাধীন ক্ষমতাশালী করবার সাথেসাথে ওপরের টাইপ পুরুষদের মত বহু পুরুষকে করে রেখেছে কুক্ষিগত অধঃস্তন। আবার পিতৃতন্ত্র যে মন্ত্র বলে টিকে আছে সেই মন্ত্রের ধারক পুরুষ, নারী উভয়ই। কেননা এ মন্ত্র নেশাগ্রস্ত করে সবাইকে। আর এ তন্ত্রে মানুষ বলে কিছু নেই, আছে নারী ও পুরুষ।
এ তৈরিকৃত সমাজব্যবস্থায় একজন ছেলেশিশু চাইলেই ঘরে বসে বোনের সাথে পুতুল খেলতে পারবে না কেননা পুতুল খেলা মেয়েলি বা ফেমিনিটির প্রকাশ। অন্যদিকে ঘরের বাইরে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোটাই পুরুষালী কিংবা ম্যাসকুলিনিটির প্রকাশ। কোথায় যেনো পড়েছিলাম-‘মেয়েশিশুটিকে ঘর গোছানো শিখিয়ে ভবিষ্যত নারী তৈরি করা হয় আর ছেলেশিশুটি ঘর অগোছালো রাখলে মা গর্বিত চোখে ভবিষ্যত পুরুষের বেড়ে ওঠা দেখতে পান!’ একজন পুরুষ চাইলেই ঘরের কাজে সাহায্য করতে পারেন কিন্তু তাকে শুনতে হবে ‘বেটিস্বভাব’ ‘মাইয়া’ ‘বৌপাগল’ এমন বহু সম্বোধন। কোন পুরুষ হয়তো আক্ষেপ করে বলছেন তার ঘরের কাজ করবার ইচ্ছা থাকলেও স্ত্রী/মা করতে দিচ্ছেন না। তাদের বলছি-‘পুরুষের তৈরি পিতৃতন্ত্রের ইল্যুশনের পাকে পড়ে মোহাবিষ্ট হয়ে আছে আপনার মা, বোন, স্ত্রী। তাদের এ থেকে বের করা/হওয়া জরুরী।’
‘নারীর দায়িত্ব পুরুষের’ পুরুষই (নারী নয় কিন্তু) বহু বহু কাল আগে এ বোধ দিয়ে তৈরি করেছিলো পিতৃতন্ত্রের স্তম্ভ। সে স্তম্ভে ছিলো আরো বহু কূটকৌশল- ‘ নারী পুরুষের অধঃস্তন’ ‘নারী পুরুষের চেয়ে দুর্বল’ ‘নারীর ভেতর শয়তানের বাস’ ‘নারী দূষিত, অপবিত্র’ ‘নারী পুরুষের সেবার নিমিত্তে তৈরি’। আর এ কূটকৌশলের অদৃশ্য পুতিগন্ধময় নর্দমায় পচে মরছে নারী। কোন পুরুষও এই একপেশে দায়িত্ববোধকে একরকম টর্চার হিসেবে দেখেন। কেননা পুরো একটা পরিবারের দায়িত্ব কম কথা নয়! এই পুরো পরিবার একজনের ঘাড়ে, সেই ঘাড়টা হতে হয় শক্ত। কিন্তু পরিবারের নারী এবং পুরুষটি দুজনের ঘাড়ে বোঝা ভাগাভাগি করে নিলে জীবনপথে চলা যায় স্বাচ্ছন্দ্যে।
এখন আমি যদি বলি-‘পুরুষরাই নিজেদের মহান/শক্তিশালী/ক্ষমতাবান/প্রভু প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের ঘাড়েই সকল দায়িত্ব নিয়েছিলো এবং সেটার সুফল শতভাগ ভোগ করছে। কুফল ভোগ করছে গুটিকয়েক পুরুষ।’ তাহলে কি ভুল হবে? ওপরের পুরুষটির মত অনেক পুরুষ আজ উপলব্ধি করছেন যে এই দায়িত্বের বোঝা দুজন মিলে ভাগাভাগি করে নিলে ভালো হত। নিঃসন্দেহে ভালো হত এবং সেভাবেই সঙ্গিটিকে বোঝানো জরুরী। নারীটিকে দোষী না করে সে যেই শৃঙ্খলিত ইল্যুশনের মধ্যে আছে তা থেকে বের করে আনতে হবে। তাকে বোঝানোও জরুরী যে সে যেটাকে সুবিধা মনে করছে আদতে সেটা দাসত্ব বৈ কিছু নয়!
সমাজে পুরুষালী কিছু বৈশিষ্ট্য প্রচলিত আছে। যে বৈশিষ্ট্য পুরুষ ধারণ করে গর্ববোধ করে, ধারণ করতে না পারার ফলে হীনমন্যতায় ভোগে। অপরদিকে নারীর জন্যও কিছু বৈশিষ্ট্য ধার্য করা হয়েছে। মূলত পুরুষের এই বৈশিষ্ট্যকে ম্যাসকুলিনিটি আর এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যকে ফেমিনিটি বা মেয়েলী বলা হচ্ছে। আর তৃতীয় বক্তব্যের পুরুষটি স্পষ্টতই ম্যাসকুলিনিটির ধারক হতে পারেননি বলে তাকে একধরণের মেন্টাল টর্চারের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেউ কী বলবেন এই ‘টর্চার সেল’ কার তৈরি? এ সেল নারীর তৈরি নয়, এটাও পিতৃতন্ত্রের স্তম্ভের শোভাবর্ধক একটি কুৎসিত পালক। যেখানে নারীকে উপস্থাপন করা হয় নরম, কোমল রূপে। আর এই রূপ কোন পুরুষের মাঝে থাকলে তিনি হয়ে যান কটাক্ষের শিকার! মনে রাখা জরুরী একজন নারী শক্ত, বলিষ্ঠ, ভারী কন্ঠস্বরের অধিকারী, রুক্ষ হলে তাকেও কটাক্ষ পেতে হয়। আর এটা কোনভাবেই নারীর তৈরি নয়! আপনাদের পূর্বপুরুষ হাজার বছর ধরে তৈরি করেছে এ ভিত। আঙুল তুলতে হয় ওদের দিকে তুলুন!
পুরুষ পিতৃতন্ত্রের যে জাল বিস্তার করেছিলো দুনিয়াব্যাপি সেই জালে যে একদিন নিজেরাই জড়িয়ে পড়বে তা বোধহয় তখন ভাবতে পারেনি। যেই জালে জড়িয়ে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত হাসফাস করেন অনেকে। অথচ এ জাল বুনেছিলো হাজার বছর আগে নিজ জাতের সহোদরেরা। এর মোহে আবিষ্ট হয়ে নারী যদি কখনো সুফল ভোগ করতেও চায় আদতে এ সুফল নয়, এ পরাধীনতা। আর তার মগজে গেঁথে দেয়া এ সুগন্ধি সুফল আসলে পুতিগন্ধময় দাসত্ব। এ থেকে নারীর বের হওয়া খুব জরুরী।
অন্যদিকে পুরুষও এখন বুঝতে পারছে সেও আসলে কোন না কোনভাবে শৃংখলিত। যদিও সে চাইলেই সুফল ভোগ করতে পারে শতভাগ কারণ পিতৃতন্ত্রের ফতোয়ার মাইকতো তার হাতেই। খেয়াল খুশিমত নাজিল করলেই হলো! তবু বহু পুরুষ আছেন যারা আত্মপোলব্ধির মাধ্যমে বুঝতে পারছেন তারাও বন্দী। তারাও ভারমুক্ত হতে চান একপেশে দায়িত্ববোধ থেকে। তারাও চান নির্মিত পুরুষের আদল থেকে বেরিয়ে নিজের মত বাঁচতে। তারাও চান সঙ্গিটি তার অধঃস্তন না থাকুক, দুজনে হোক একে অপরের যোগ্য সঙ্গী। যদিও তারা ঠিক প্রতিটা ক্ষেত্রে সমতা চান কীনা জানিনা, তবু কিছু জায়গাতো চাইছেন! যদিও নিজের মুক্তির নিমিত্তে চাইছেন, তবু অন্তত দেখতেতো পাচ্ছেন তিনিও কোন না কোনভাবে শৃঙ্খলিত।
পুরুষগণ, আপনার গলায় চেপে বসা পিতৃতন্ত্র তৈরি করেছিলো আপনার পূর্বপুরুষ। এর দাসত্ব করে আসছে নারী হাজার বছর ধরে। আপনার কষ্ট-যন্ত্রণার আহাজারি হাজার বছরের শোষিত নারীর চিত্রের কাছে ঠাঁই পাবে? কোনভাবেই পাবে না, স্রেফ তলিয়ে যাবে! আপনার এ উপলব্ধি, আপনার এ আহাজারি পৌছে যাক সিস্টেমের কর্ণকুহরে। পূর্বপুরুষের তৈরিকৃত নর্দমাই একমাত্র পথ এ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসুন। আসুন, হাতে হাত রেখে নির্মাণ করি এক সাম্যবাদী সমাজ যেখানে নারী-পুরুষ হবে সমানে সমান। যেখানে দাপুটে পুরুষালী বৈশিষ্ট্য ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে উচ্চ-অধঃ মানসিকতা।
ওহে নারীগণ, বের হও, জাগো, মুক্ত হও এ নেশা থেকে। তোমার দায়িত্ব পুরুষের, তারমানে তোমাকে ওরা করেছে দাস। সুন্দরের নামে তোমাকে করেছে নরম, দুর্বল। মেয়েলীপনার খোলসে আবৃত করে তোমাকে করেছে হেয়। বেরিয়ে এসো, স্বাধীনতার স্বাদ নাও। আত্মকে উপলব্ধি করে দেখো, তোমার ভেতরে বাস করছে এক দুর্বার শক্তি। যে শক্তি নিজেই পূর্ন, কারো অধঃস্তন নয়। পিতৃতন্ত্রের নেশা থেকে বেরুলেই বুঝবে যাকে তোমরা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছো ওটা তোমার মহাপতন! যার চিত্র আজকের দুর্বল শৃঙ্খলিত নারী।
ফাহমি ইলা : উন্নয়নকর্মী, কলাম লেখক।