পুরুষের সেই ভূমিকা এখন হুমকির সম্মুখীন
ফরিদ আহমেদ-
নারী-পুরুষের প্রধান পার্থক্যটা বায়োলজিক্যাল। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে মানব প্রজাতির এই দুই লিঙ্গের মাঝে। নারী গর্ভ ধারণ করতে পারে, সন্তান জন্ম দিতে পারে। আর, পুরুষ পারে নারীকে গর্ভবতী করতে। পুরুষেরা আকার-আকৃতিতে বড়, শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং স্বভাবে আক্রমণাত্মক। অন্যদিকে, নারীরা দৈহিক গড়নে খাটো, শারীরিকভাবে কোমল, স্বভাবে অনাক্রণাত্মক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ।
এই বায়োলজিক্যাল পার্থক্যই নারী-পুরুষের মধ্যে কাজের তফাৎ করে দিয়েছে অনাদিকাল থেকে। পুরুষের মূল কাজ হয়েছে, তার সঙ্গিনী এবং সন্তান-সন্ততিকে বন্য পশু এবং অন্য পুরুষের কাছ থেকে নিরাপদে রাখা। তার দ্বিতীয় প্রধান কাজ হয়েছে পর্যাপ্ত খাদ্য এবং নিশ্চিত আশ্রয় জোগাড় করা যাতে করে পরিবারের সবাই সুস্থ এবং সবল থাকে। এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্ম বংশ বিস্তারের সময় সক্ষম এবং সক্রিয় থাকে। আব্রাহাম মাসলো মানুষের চাহিদার যে ক্রম সাজিয়েছেন, সেই ক্রমে এ’দুটো হচ্ছে মৌল চাহিদা। মানুষের ইতিহাসের একটা দীর্ঘ সময় ধরে পুরুষের বিশেষ ভূমিকা ছিলো নিরাপত্তাপ্রদায়ক এবং খাদ্যের যোগানদাতা হিসাবে।
পুরুষের সেই ভূমিকা এখন হুমকির সম্মুখীন। বেশিরভাগ উন্নত বিশ্বেই এখন আর একজন নারীর নিরাপত্তার জন্য পুরুষ সঙ্গীর প্রয়োজন নেই। খাদ্যের যোগানের জন্যও পুরুষ এখন অদরকারী। প্রতিটা দেশেই পুলিশ এবং সিভিল সোসাইটি নিরাপত্তার এই মৌল ভূমিকাটি পালন করছে। নারীর ক্রমবর্ধমান চাকরির বাজার খাদ্যের জন্যও নারীকে অনির্ভরশীল করে তুলেছে পুরুষের ওপর।
নারী, পুরুষের তুলনায় শারীরিকভাবে খাটো, ওজনে কম এবং দুর্বল, এই ধারণার ভিত্তিও ইদানীং নড়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সর্বত্রই নারীর দৈহিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসছে। দৈর্ঘ্যে এবং ওজনে বৃদ্ধি পাচ্ছে তারা। দৈহিক শক্তিও নারীর আগের তুলনায় এখন বেশি। এর সাথে নারীর আরেকটা সুবিধা হচ্ছে, তাদের সেক্সুয়াল ম্যাচুরিটি আসে পুরুষের তুলনায় আগে। অনেকের ধারণা ছিলো এই পরিবর্তন ঘটেছে নারী-মুক্তির কারণে আসা মনোবৈজ্ঞানিক কারণ থেকে। কিন্তু, আসল কারণ সেখানে নয়। পুষ্টিগত খাবারে নারীর অধিকার নিশ্চিত হওয়ার কারণেই তার দৈহিক আকৃতির এই পরিবর্তন, এই উন্নয়ন সূচিত হচ্ছে।
নারী এবং পুরুষের এক সময়ের ‘প্রাকৃতিক’ শ্রমবিভাজন এখন আর নেই বললেই চলে। এখন ডিম্ব আর শুক্রাণুর প্রাকৃতিক পার্থক্য ছাড়া, আর কোনো কিছুতেই নারী-পুরুষের পার্থক্য চোখে পড়ছে না। পুরুষ শুক্রদাতা এবং নারী গ্রহীতা, এই সুবিধাজনক সম্পর্ক বাদে পুরুষের ভূমিকাগত আর কোনো সুবিধা নেই। কিন্তু, এই ভূমিকাও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বিজ্ঞান নারীকে নিজের প্রজননের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে সাহায্য করেছে। সন্তান নেবে কে নেবে না, এই সিদ্ধান্ত এখন নারী নিজেই নিতে পারছে। ফলে, পুরুষ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, কৃত্রিম প্রজননব্যবস্থা আসার কারণে, পুরুষ সঙ্গীর উপস্থিতি ছাড়াও নারী গর্ভধারণ করতে পারছে। সক্ষম পুরুষকে আপন হিসাবে গ্রহণ না করেও নারী তার জেনেটিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলোকে বেছে নিতে পারছে। নীল চোখের বাচ্চা দরকার, কিংবা সোনালি চুলের, সেরকম জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের শুক্র নারী বেছে নিতে পারে প্রাকৃতিক উপায়ে সঙ্গী নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট হয়ে, কিংবা সঙ্গী বাছাই না করে স্পার্ম ব্যাংক থেকেও বেছে নিতে পারে কৃত্রিম প্রজননে গিয়ে।
বিজ্ঞান যদিও এখনও পুরুষকে বাদ দিয়ে শুক্রাণু তৈরি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেনি। তারপরেও, নারীদের জন্য খুব একটা অসুবিধা কিছু নেই। ক্লোনিং টেকনোলজি আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছে। যদিও এটা এখন পর্যন্ত বে-আইনি। আইনগতভাবে এটাকে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তবে, ভবিষ্যতে যে পারা যাবে না, এ’কথা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। পুরুষকে বিজ্ঞান পুরোপুরি বাতিল করে দেয়নি, কিন্তু স্পার্মকে পুরুষ থেকে আলাদা করে ফেলায়, পুরুষের গুরুত্ব কমে গেছে বিপুল পরিমাণে। নারীর যে শেষ প্রাকৃতিক সুতা বাধা ছিলো পুরুষের কাছে, তার স্পার্মের জন্য, সেটাও আলগা হয়ে গিয়েছে।
একজন শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীর জন্য এখন আর তার নিরাপত্তার জন্য, খাদ্যের জন্য কিংবা বংশবৃদ্ধির জন্য পুরুষ সঙ্গীর প্রয়োজন নেই। এর মানে এই না যে নারীর আর পুরুষের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন আছে, তবে আগের মতো সেই নির্ভরশীলতা আর নেই। ক্যাথি ল্যানোস্কি নামের একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা যেমন বলেছেন, “বেশির ভাগ নারীই পুরুষ সঙ্গী চায়। তবে, সেই চাওয়াটা আর পুরনো যুগের মতো নেই। আগে যেমন টাকার জন্য, পরিবার গঠনের জন্য, সন্তান নেবার জন্য পুরুষের প্রয়োজন হতো এখন আর সেরকম নেই। এগুলো সবই একজন নারী পেতে পারে স্থায়ী পুরুষ সঙ্গী ছাড়াও।”
ক্যাথি ল্যানোস্কির মতো এতোখানি ভদ্রতা দেখাতে যায়নি সিন্থিয়া নামের এক ডাচ তরুণী। জীবন যাপনের জন্য পুরুষ সঙ্গীর খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে সে মনে করে না। যদিও পুরুষের কিছু উপকারিতা আছে, এ বিষয়টাকে অস্বীকার করেনি সিন্থিয়া। তার বক্তব্য হচ্ছে, “নারী এখন অনেক বেশি স্বাবলম্বী, তারপরেও আবর্জনা ফেলার জন্য কাউকে প্রয়োজন আছে। আর সেই কেউ-টা হচ্ছে পুরুষ। আবর্জনা ফেলার জন্য যে পুরুষ আছে, সেটা নিজেই আমি টের পাই হাড়ে হাড়ে, ভাগ্যের ফেরে নারীবাদী এই দেশে এসে।