পৌনে-পাকিস্তানিদের জন্য……
আক্তারুজ্জামান আজাদ (ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)
বাংলাদেশের যে পৌনে-পাকিস্তানি প্রজন্মটি ক্রিকেটে পাকিস্তানকে সমর্থন করে, এর পেছনে তারা কমন কিছু অজুহাত দাঁড় করিয়ে থাকে। অজুহাতগুলো তাদের পাক পিতাদের মতোই লম্বা-চওড়া, পাকসেনাদের মতোই গাট্টাগোট্টা এবং তাদের ঘ্রাণপুরুষ আফ্রিদির মতোই সেক্সি।
পাকপ্রেমের ঢাল হিশেবে এরা প্রথমেই দাঁড় করায় বঙ্গবন্ধুকে। তাদের দাবি— বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে স্বাধীন বাংলাদেশে সংবর্ধনা দিতে পারলে আফ্রিদিদের সাথে সঙ্গমস্বপ্নে বিভোর হওয়াও জায়েজ। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, বিরোধিতা করেছিল অধিকাংশ আরব দেশও। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন না করলে আমরা দেশপুনর্গঠনে ঐ রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা তো পেতামই না, পেতাম না ন্যূনতম স্বীকৃতিও। এমনকি আমরা যদি এখনও পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করি, তা হলেও ঐ একই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে। ঘরে বসে দেশোদ্ধার করা আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। তাই পাকিস্তানের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে, ভুট্টোর জন্য লালগালিচা বিছাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই পাকপ্রেমীদের কেউই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা না মানলেও পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থনের ছুতো হিশেবে প্রথমে ঐ বঙ্গবন্ধুকেই ব্যবহার করে!
‘খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না’ পাকপ্রেমীদের প্রিয়তম জিকির ও বৃহত্তম ফিকির। আফ্রিদিরা পাকিস্তানের পতাকা নিয়েই খেলতে নামে, হন্ডুরাসের পতাকা নিয়ে না এবং ম্যাচের আগে তারা পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতই গায়, কোনো ভুটানি গান গায় না এবং পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড বেসরকারি কোনো ক্লাব না, খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রই এর পৃষ্ঠপোষক। অর্থাৎ পাকিস্তান ক্রিকেটদল পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই প্রতিশব্দ এবং পাকিস্তান ক্রিকেটদলকে সমর্থন করা মানে গোটা পাকিস্তানকে এবং তাদের পতাকা ও জাতীয় সংগীতকেও সমর্থন করা, যা একজন বাংলাদেশীর জন্য ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। খেলা ও রাজনীতি বরাবরই মিলে-মিশে একই বিছানায় ঘুমোয় এবং বাচ্চা পয়দা করে।
পাকপ্রেমীরা দাবি করে— একাত্তরে অপরাধ করলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী করেছে, খেলোয়াড়রা করেনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের ক্রিকেট-বাবা ইমরান খান আশি সালে প্রথম বাংলাদেশ সফরে এসে বিমানবন্দরে বাংলাদেশী ভক্তদের দেওয়া ফুলের মালা পদদলিত করেছিল এবং সালামের জবাব না দিয়ে বাংলাদেশের সব মানুষকে হিন্দু আখ্যা দিয়ে সবাইকে নমস্কার বলেছিল এবং এসব জন্য চট্টগ্রামের দর্শকরা মাঠে ঢুকে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদেরকে পিটিয়ে খেলা পণ্ড করেছিলেন। বর্তমানে যারা পাকিস্তানদলে খেলছে, একাত্তরের ভূমিকার জন্য তারা কখনও বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি; বরং আমরা দেখে চলছি রমিজ রাজাদের বাংলাদেশবিরোধী পাকসেনা-সুলভ ভূমিকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ইশুতে একাত্তরের পাকসেনাদের সাথে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মানসিকতার কোনোই পার্থক্য নেই এবং ইমরান-রমিজরা খেলার সাথে রাজনীতি মিশিয়ে প্রত্যহ তিনবেলা শরবত বানিয়ে খেলেও বাংলাদেশের পাকপ্রেমীরা খেলার সাথে রাজনীতি মেশাতে একেবারেই নারাজ!
পাক ছানারা খেলার সাথে রাজনীতি না মেশালেও ধর্ম মেশাতে খুবই উদগ্রীব এবং পাকপ্রেমের ঢাল হিশেবে তারা ‘মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই’ তত্ত্বটিও ব্যবহার করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপে ইরান-সৌদি-মরোক্কো-তুরস্কর মতো মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলো খেললেও এরা কখনোই এই দলগুলোকে সমর্থন করে না; করে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল-জার্মানি-ইতালির মতো অমুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোকে, ছাদে ওড়ায় এই ‘ইহুদি-নাসারাদে
রই’ পতাকা! পাকপ্রেমীরা পাকিস্তানকে নাকি ‘এশিয়ান কান্ট্রি’ হিশেবে সমর্থন করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শ্রী লঙ্কা পাকিস্তানের চেয়ে শতগুণ ভালো খেললেও এবং এশিয়ায় আরো একটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ (আফগানিস্তান) ক্রিকেট খেললেও তারা কেবল পাকিস্তানকেই সমর্থন করে। অর্থাৎ তাদের এশীয় একতা ও ইসলামি ভ্রাতৃত্বটুকু কেবল পাকিস্তানের জন্যই বরাদ্দ!
এই পাকপ্রেমীদের বৃহত্তম অস্ত্র হচ্ছে ভারত, ভারতের প্রতি তৈরি বিদ্বেষকে তারা পাকপ্রেম জায়েজকরণে ব্যবহার করে থাকে। পূর্বের একটি লেখায় আমি ইতোমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছি— ভারত পাকিস্তানের বিপরীতশব্দ নয়, ভারত ও পাকিস্তান একই পাল্লায় পরিমাপযোগ্যও নয়; ভারতকে যে-কেউ অপছন্দ করতে পারে, কিন্তু ভারতকে অপছন্দ করলেই পাকিস্তানকে সমর্থনের সুযোগ নেই। ভারতবিরোধিতা কোনোভাবেই পাকিস্তানপ্রেমের অজুহাত হতে পারবে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে ভারতে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম বসবাস করলেও এবং ভারত দলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম খেললেও এদের প্রেমের নদী বরাবরই পাকিস্তানের দিকে ধাবিত!
‘আমার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন’— পাকপ্রেমীদের আরেকটি ঢাল এবং এই ঢালটি সর্বৈব মিথ্যার চাদরে ঢাকা। পাকপ্রেমকে বৈধ করতেই নব্য রাজাকাররা এই জঘন্য মিথ্যাচারটির আশ্রয় নেয়। কোনো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সত্যিই পাকিস্তানের সমর্থক হলে এমন কুলাঙ্গারকে জন্ম দেওয়ার কাফফারা হিশেবে ঐ মুক্তিযোদ্ধার উচিত আত্মহত্যা করা।
এই পৌনে-পাকিস্তানিদের সাথে কিছুক্ষণ কথা চালাচালি করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়— তারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানে না, মুক্তিযুদ্ধকে গণ্ডগোল মনে করে, ‘অতীত’ নিয়ে ‘ঘাঁটাঘাঁটি’ অপছন্দ করে, রাজাকারদের বিচার চায় না, গোলাম আজমকে ভাষাসৈনিক মনে করে, শহিদমিনারে ফুল দেওয়াকে শেরেক মনে করে। বাংলাদেশবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থি এই কথাবার্তাগুলো প্রকাশ্যে বলা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ক্রিকেট এদেরকে সুযোগ দিয়েছে পাকিস্তানের প্রতি প্রকাশ্য প্রেম দেখানোর, মাঠে পাকি পতাকা ওড়ানোর। ধর্ম বা এশিয়াতত্ত্বও না, ভুট্টো বা মুজিবতত্ত্বও না, ভালোখেলা বা মন্দখেলাতত্ত্বও না; পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থনের পেছনে কাজ করে কেবলই পাকিস্তানপ্রেম এবং এই প্রেমটা কেবল ক্রিকেটদলটির প্রতি না, গোটা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি। আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ হলে এরা নির্ঘাত রাজাকারের খাতায় নাম লেখাবে। চোখে আঙুল ও পায়ুপথে বায়ু ভরে যুক্তি দেখালেও এই নব্য রাজাকাররা কখনোই পাকিস্তানের সাথে ‘ব্রেকআপ’ করবে না, বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের দিনও ধর্ষিত মায়ের যোনিতে বাঁশ পুঁতে এরা পাকিস্তানের ঝাণ্ডা ওড়াবেই!