বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবে এসে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। জনগণের স্বার্থের সঙ্গে, দেশের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে তিনি একাত্ম করতে পেরেছিলেন অবলীলায়া।আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, দেশের স্বার্থের কাছে, জনগণের স্বার্থের কাছে তিনি নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। এ কারণেই বোধ করি কবি-মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের আর এক নাম রেখেছেন mujibland. এক অর্থে বঙ্গবন্ধুই একটা পর্বের, বাংলাদেশের ইতিহাস। তার জীবন ও কর্মের ক্রমিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি বিশেষ সময়খণ্ডের কথা আমরা জানতে পারি।
শোষক ও শোষিতের সংগ্রামে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেক তিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করতে চেয়েছেন, চেয়েছেন দেশকে স্বাধীন করতে। এ মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভেবে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, কিশোর বয়স থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন প্রতিবাদ, সর্বদা বলেছেন সত্য ও ন্যায়ের কথা এবং হয়ে উঠেছেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে তিনি কখনও দূরে সরে যাননি, ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও সর্বদা তিনি সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন, শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। শোষিত মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এ নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি কেবল বাংলাদেশেই নয়, শোষিত-নির্যাতিত বিশ্বমানব সমাজেও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কথা, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন- ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন- এসব স্থানে শোষিত মানুষের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়, বিশ্বের শোষিত-নির্যাতিত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করে নেয় নিজেদের নেতা হিসেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র সৈনিক। তার কর্ম ও সাধনা, চিন্তা ও ধ্যানে সর্বদা ক্রিয়াশীল থেকে বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ। কৈশোর থেকেই তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার।বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের মহান গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি পালন করেন নেতৃত্বের ভূমিকা। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান শক্তি-উৎস ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে তিনি ছিলেন সর্বদা বজ কণ্ঠ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের তার ভাষণ ছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে স্বাধিকারের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক দলিল। একটি ভাষণ একটি জাতিকে জাগ্রত করেছে, সবাইকে মিলিয়েছে একবিন্দুতে- এমন ঘটনা বিশ্ব ইতিহাস বিরল। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ কথাই যেন ব্যক্ত হয়েছে অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই শব্দগুচ্ছে- ‘যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা গৌরী-মেঘনা বহমান/তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

বাংলাদেশের মাটিতে বিদেশি কোনো শক্তির শাসন তিনি মেনে নেননি। এজন্য তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, কারাগারে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। দেশের প্রতি, দেশের মাটির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন, সেখানেও দেশের মাটির কথা তিনি চরম বিপদের মুখেও উচ্চারণ করেন নির্ভীকচিত্তে। দেশকে ভালোবাসতেন বলে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন মিলিত বাঙালির। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল তার মজ্জাগত, মানবিক চেতনায় তিনি সর্বদা ছিলেন উচ্চকিত। তিনি ছিলেন বাঙালির ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির ধারক।

মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে তার কাছে সর্বদা প্রাধান্য পেয়েছে মানবপরিচয়। এ কারণে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে তিনি ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির ধারক বাঙালির জন্য অসম্মানের বলে মনে করতেন। বাংলাদেশ ও বাঙালি সত্তাকে তিনি কী বিপুলভাবে ভালোবাসতেন, তা বোঝা যায় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি যে ভাষণ দেন, তা থেকে। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন- পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের মুখের ওপর তিনি বলেছেন : ‘আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল।… আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা।’

এ বক্তব্য থেকেই অনুধাবন করা যায়, দেশের জন্য, বাঙালির জন্য, বাংলা ভাষার জন্য বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসা। ১০ জানুয়ারির ভাষণে কেবল দেশপ্রেম নয়, বঙ্গবন্ধুর উদার মানবতাবোধ এবং সদর্থক বিবেচনারও পরিচয় ব্যক্ত হয়েছিল। সেদিনের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছিল এই উদার মানবচেতনা, এই মহৎ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা-

আমার পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা, আপনাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। আমি চাই আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সেনাবাহিনী আমাদের অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে, আমাদের অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে, আমাদের গ্রামগুলো বিধ্বস্ত করেছে, তবুও আপনাদের প্রতি আমার কোনো আক্রোশ নেই। আপনারা স্বাধীন থাকুন, আমরাও স্বাধীন থাকি। বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যে ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে আপনাদের সঙ্গেও শুধু সেই বন্ধুত্বই হতে পারে। কিন্তু যারা অন্যায়ভাবে আমাদের মানুষদের মেরেছে, তাদের অবশ্যই বিচার হবে।

-শেষের বাক্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু সচেতনভাবে এখানে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলেছেন। যুদ্ধাপরাধের এই বিচার প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক এক ডিসকোর্সের সামনে আজ বাংলাদেশ। এ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের বক্তব্য আরও তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। হেমিলনের বংশীবাদকের মতো বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করেছেন। তিনি হলেন রাজনীতির কবি- Poet of politics। রাজনীতিকে তিনি সৃষ্টিশীল চেতনা দিয়ে নিজের হাতে আকার দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে, শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে, প্রকৃত দেশপ্রেম নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। সেটিই হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ উপায়। শ্রুতিলিখন- এমরান হোসেন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn