বাউল শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী
বার্তা ডেক্সঃঃবাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের একাদশ মৃত্যুবার্ষিকী আজ শনিবার। ২০০৯ সালের এই দিনে ৯৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি। ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গুণী এই ব্যক্তি। আমৃত্যু তিনি ওই গ্রামেই ছিলেন। শাহ আবদুল করিম জীবনভর তার গানে অবহেলিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কথা বলে গেছেন। তার গানে যেমন প্রেম-বিরহ ছিল, তেমনি ছিল খেটে খাওয়া মানুষের কথা। একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক ভাবনাও রয়েছে তার সৃষ্টিকর্মের বিশাল অংশজুড়ে। অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্যে বেড়ে ওঠা বাউল করিমের বয়স যখন ১২, তখন রাখালের চাকরি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী ধলবাজারের এক মুদি দোকানে কাজ নেন। দিনে চাকরি আর রাতে হাওর-বাঁওড় ঘুরে গান গাইতেন। ওই সময় গ্রামের নৈশবিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পড়াশোনা হয়নি করিমের। গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাউল, ভাটিয়ালি, পালাগান গাইতেন তিনি। পুরো ভাটি এলাকায় নাম ছড়াতে থাকে তার। এরপর বিভিন্ন আন্দোলনে গণসঙ্গীত গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেন তিনি।
তার ১১তম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে বাউলের সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজান ধলের গ্রামের বাড়িতে দুপুরে মিলাদ মাহ্ফিল্, রাতে সিমিত পরিসরে বসবে বাউল আসর। করোনা ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন সংগঠন অনলাইনে পৃথক পৃথক কর্মসূচির আয়োজন করেছে। শাহ আব্দুল করিম স্বাধীনতা পূর্ব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি গণসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যখন বৃহত্তর সিলেটে গণসংযোগে আসতেন তখন তাঁদের সফর সঙ্গী হতেন শাহ আবদুল করিম। ১৯৫৫ সালে সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিষ্ট্রি ময়দানে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সিলেট আগমন উপলক্ষ্যে জনসভায় শাহ আবদুল করিম গণসঙ্গীত গেয়েছিলেন।
১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে শাহ আবদুল করিমের গান শুনে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘তুমি ভবিষ্যতে গণমানুষের মহান শিল্পী হবে’। সেদিন গণসঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে ভাসানী ১৮৫ টাকা পুরষ্কার প্রদান করেন। ১৯৬৭ সালে সুনামগঞ্জে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান আবদুল করিম সংগীত শুনে তাকে ১১০০ টাকা দিয়ে বলেছিলেন ‘আমি যতই করিম ভাইকে দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। এ দেশের উন্নয়নে আপনারমতো গুণী শিল্পীর প্রয়োজন অনেক’। পরে ১৯৬৯ সালে আবারো সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর সভামঞ্চে শাহ আবদুল করিম গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। গণসঙ্গীত শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে বঙ্গবন্ধু মাইকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ‘শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বাঁচবে’। এসময় তিনি শাহ আবদুল করিমকে পাঁচশত টাকা উপহার দেন।
বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম তাঁর উজান ধল গ্রামে নিজ বাড়িতে ‘শাহ আবদুল করিম সংগীতালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রচিত ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, গণসঙ্গীত ইত্যাদি অসংখ্য গান দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ধল গ্রামে জন্ম নেয়া সৃজনশীল সৃষ্টি কর্মের উজ্জল নক্ষত্র, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম ২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর সিলেট শহরে একটি ক্লিনিকে মৃত্যুবরণ করেন। সমাজ পরিবর্তনের স্বাপ্নিক বাউল ছিলেন শাহ্ আব্দুল করিম। অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন তিনি। গানে-গানে অর্ধ শতাব্দিরও বেশী লড়াই করেছেন ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। এজন্য মৌলবাদীদের দ্বারা নানা লাঞ্চনারও শিকার হয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক পান ক্ষণজন্মা এ বাউল। করোনা ভাইরাসের কারণে প্রতি বছরের মতো এবারও গণ-মানুষের প্রিয় এই বাউলের মৃত্যুবার্ষিকীকে ঘিরে তার ভক্ত বাউলরা সমবেত হচ্ছেন না তার বাড়িতে। শাহ আব্দুল করিম পরিষদের সভাপতি ও তার ছেলে বাউল শাহ নূর জালাল বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য আজ পর্যন্ত বাবার নামে দিরাইয়ে একটি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। দিরাইয়ে শহরে শাহ আব্দুল করিম একাডেমী গড়ার জন্য একবার আলোচনা হয়েছিল, তা আলোর মূখ দেখিনি। বাবার মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে দুপুরে মিলাদ মাহ্ফিল্, রাতে সিমিত পরিসরে বাউল আসর বসবে। করোনা ভাইরাসের কারণে বড় কোন কর্মসূচির হাতে নেওয়া হয়নি।