আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী- লন্ডনে বাঙালিপাড়া নামে খ্যাত হোয়াইট চ্যাপেলে বাঙালিরা যায় সাধারণত বাংলাদেশের মাছ, তরিতরকারি কিনতে। আমি যেতাম বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। হঠাত্ দুরারোগ্য নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মাসাধিক কাল হাসপাতালে থাকার দরুন এই আড্ডায় যেতে পারিনি। এমনকি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেও যেতে পারছি না। বয়স এবং অসুস্থতার ভারে দুর্বল শরীর নিয়ে গৃহবন্দি হয়ে আছি। তবে আমার বন্ধুভাগ্য ভালো, আমাকে সঙ্গ দিতে, সাহস জোগাতে অনেকে দূরের পথ পাড়ি দিয়ে আমার বাসায় আসেন। আমার আড্ডাগত প্রাণ তাতে জুড়ায়। আমার কাছে যেসব বন্ধু আসেন, তারা সবাই আমার সহমতের বন্ধু নন। বিপরীত মতের বন্ধুও আসেন। তাদের মধ্যে বিএনপির সমর্থক দু’একজন বন্ধুও রয়েছে। তাদের একজন লন্ডনের শহরতলীর এক কলেজে অধ্যাপনা করেন। বিএনপির কট্টর সমর্থক না হলেও মোটামুটি সমর্থক। সম্প্রতি একদিন তিনি আমার বাসায় এসে আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, ‘আপনি দেশের একজন পাঠকপ্রিয় কলামিস্ট বটে, তবে নিরপেক্ষ কলামিস্ট নন।’ বলেছি, আমি দলনিরপেক্ষ কলামিস্ট বটে, কিন্তু মতনিরপেক্ষ কলামিস্ট নই। আমার একটা দৃঢ় মত আছে, তা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে। এই আদর্শের পক্ষের ও বিপক্ষের দলকে আমি একপাল্লায় ওজন করি না। বন্ধু বললেন, আপনি দলনিরপেক্ষ নন। বিএনপির প্রতি আপনার দারুণ উষ্মা, বিএনপির কথা উঠলেই তার কঠোর সমালোচনা করেন। বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে বিএনপির কোনো অবস্থান নেই।

বন্ধু বললেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার দাবি করেন। সে যাই হোক, আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে আপনি আপনার কলামে বার বার জোর দিয়ে বলছেন, দলটি নির্বাচনে যাবেই। দল বলছে, তারা নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধান ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। দাবি আদায়ের জন্য তারা আন্দোলনে যাবে। আপনি দলটিকে হেয় করার জন্য বারবার লিখছেন, বিএনপি নির্বাচনে যাবেই। আপনি সাংবাদিক না জ্যোতিষী? বন্ধুকে বলেছি, বিএনপি যে নির্বাচনে যাবে এটা বোঝার জন্য জ্যোতিষী হওয়ার দরকার নেই। দেশের একজন সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও বুঝতে পারছে বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যাবে। এ সম্পর্কে আপনাকে একটা গল্প বলি, ব্রিটিশ আমলে যখন অনেক বৈঠক ও আলোচনা শেষেও কংগ্রেস নেতারা—বিশেষ করে নেহেরু ও প্যাটেল ভারত ভাগ তথা পাকিস্তানের দাবি মেনে নেননি, তখন অনেকেই বলেছিলেন উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দানের মাউন্টব্যাটেন-পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়ে গেল। ভারতের রাজনীতিতে অচলাবস্থা চলবে। তখন মহাত্মা গান্ধীর বেয়াই স্বতন্ত্র রাজনৈতিক নেতা রাজা গোপালাচারিয়া বলেছিলেন, “আপনারা দু’দিন অপেক্ষা করুন। নেহেরু-প্যাটেল পাকিস্তান দাবি মেনে নিয়ে মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। জিন্নাহও ‘ট্রাঙ্কেটেড পাকিস্তান’ গঠনের অফার গ্রহণ করবেন। তার কারণ কি জানেন, কংগ্রেস নেতারা সারা জীবন জেল খেটেছেন। এখন বুড়ো হয়েছেন। এখনই ভারত-ভাগের প্রস্তাব মেনে ক্ষমতায় না গেলে তাদের পক্ষে স্বাধীন ভারত দেখা ও তাতে ক্ষমতায় বসা সম্ভব হবে না। তাদের প্রজন্মের যুগ শেষ। আরো বেশিদিন ভারতের স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করলে ক্ষমতায় বসা তাদের আয়ুতে কুলোবে না। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব তাদের স্থান দখল করবে।”

রাজা গোপালাচারিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী দু’দিন পরেই সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। কংগ্রেসের নেহেরু-প্যাটেল নেতৃত্ব ভারত ভাগের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন এবং জিন্নাও পাঞ্জাব ও বাংলাভাগসহ তার কথিত ট্রাঙ্কেটেড পাকিস্তান গঠনের অফার গ্রহণ করেছিলেন। আর ভবিষ্যদ্বক্তা রাজা গোপালাচারিয়া লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পর হয়েছিলেন ভারতের প্রথম ভারতীয় গভর্নর জেনারেল। জিন্নাহ হয়েছিলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। কিন্তু এক বছরের বেশি ক্ষমতাভোগ করতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছর ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। সুতরাং সময় মতোই তিনি ভাঙা পাকিস্তানের অফার গ্রহণ করেছিলেন। এই গল্পটা বন্ধুকে শোনাবার পর বলেছি, বিএনপি’র নেত্রী বেগম জিয়ারও বয়স হয়েছে এবং নানারকম রোগে ভুগছেন। বিএনপি’র প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের, যেমন ডা. বদরুদ্দোজা, অলি আহমদ প্রমুখকে তারেক রহমান বহু আগেই দল থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছেন। এম.কে. আনোয়ার, জেনারেল শওকতসহ অনেকে মারা গেছেন। বাকি প্রবীণ যারা আছেন তারা হয় নিষ্ক্রিয়, নয় বয়সের ভারে কাতর। দলে তারেক রহমানের দৌরাত্ম্যে সত্ ও নতুন নেতৃত্ব এগিয়ে আসতে পারেনি। মির্জা ফখরুল, রিজভী এরা বিএনপি’র ভবিষ্যত্ নন। খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্বে না থাকলে এদের দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হবে।

খালেদা জিয়া নিজেও এটা জানেন। এবার নির্বাচনে গিয়ে জয়ী হওয়ার চেষ্টা না করলে আরো পাঁচ বছর অপেক্ষা করার সময় তার নেই। পুত্র তারেককেও বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের মামলা-মোকদ্দমার জটমুক্ত করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা দানের সুযোগ থাকবে না। কোনো মামলায় হয়ত তার দীর্ঘমেয়াদি সাজাও হয়ে যেতে পারে। এবারের নির্বাচনই বিএনপি’র শেষ সুযোগ, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে যদি তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রোটেস্ট ভোটের জোরে জিতে যেতে পারেন, তাহলে তিনি নিজে বাঁচবেন, তারেক রহমানকেও বাঁচানো যাবে। দলও বাঁচবে। আরো একটি বড় কথা, বিএনপি কোনো আদর্শ ও নীতিভিত্তিক দল নয়। একজন সেনাপতি বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী কিছু দলের লোককে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে নিজের পক্ষে এনে বিএনপি গঠন করেছিলেন। বিএনপি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় না থাকলে এরা এই দলে থাকবেন না। এবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পারুক, সংসদীয় দল হিসেবে নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে না পারলে টিকে থাকতে পারবে না। হয় বিভক্ত হবে, নয় পাকিস্তানে জেনারেল আইয়ুবের কনভেনশন মুসলিম লীগের মতো বিলুপ্ত হবে।

বিএনপি’র এই বিলুপ্তি জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরই ঘটত। কেন, শাহ আজিজুর রহমান পাল্টা বিএনপি গঠনের চেষ্টা করেননি? বিএনপি’তে ভাঙন দেখে দলের “অদৃশ্য অভিভাবকেরা” তাড়াতাড়ি বেগম খালেদা জিয়াকে নেতৃত্বে এনে এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাকে “আপসহীন নেত্রী” সাজিয়ে বিএনপি’কে রক্ষা করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ভাগ্যক্রমে জয়ী হওয়ায় দলটি টিকে যায়। দেশে বাম গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিপর্যয় এবং একটি সুশীল সমাজের চরম সুবিধাবাদী নীতির জন্য জামায়াত ও চরম মৌলবাদী দলগুলোর সমর্থন নিয়ে বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হয়ে দাঁড়ায়। আশা করা গিয়েছিল, বেগম জিয়া এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার দলকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হিসেবে পুনর্গঠন করবেন। তিনি তা করেননি। সেই রাজনৈতিক শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা তার ছিল না, এখনো নেই। তিনি কিছুদিনের মধ্যে তারেক রহমান ও তার চরিত্রহীন বন্ধু ও জামায়াতি উপদেষ্টাদের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি’র নির্বাচন-জয় ছিল শক্তিশালী দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের যোগসাজশের ফল। এই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসার পর ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসন যেকোনো স্বৈরাচারী শাসনকে লজ্জা দেয়। তারই পরিণতি ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশাল পরাজয়।

এই পরাজয়ের ধাক্কা থেকে বিএনপি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। মির্জা ফখরুল, মওদুদ, রিজভীদের অসার বাগাড়ম্বর ছাড়া বিএনপির আর কোনো রাজনৈতিক মূলধন নেই। তারেক রহমান বিদেশে বসে একটার পর একটা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন আর আশা করছেন, ষড়যন্ত্রের দ্বারাই তারা একদিন আবার ক্ষমতায় যাবেন। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেছে। বাংলাদেশে বিএনপি-সমর্থক সুশীল সমাজের “দুই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতা” আশা করছিলেন, আমেরিকার গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাদের মিত্র হিলারি ক্লিনটন জয়ী হবেন এবং তাদের ষড়যন্ত্রে সহায়তা দেবেন। তাও হয়নি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাংলাদেশের এই সুশীল সমাজ যার কাছে একেবারেই অপরিচিত। এই পরিচয় ঘটাতে সময় লাগবে। বিএনপি সমর্থক বন্ধুকে বলেছি, বিএনপি যে আগামী নির্বাচনে যাবে এটা বোঝার জন্য জ্যোতিষী হওয়ার দরকার নেই। দলটির নেতারা মুখে যতই হুমকি-ধামকি দিন, দেশের রাজনীতির বাস্তব পরিস্থিতি তারা বোঝেন। বিএনপির কোনো সংগঠন-শক্তি নেই (কিছু জনসমর্থন থাকতে পারে)। জামায়াতের মতো সন্ত্রাসী দলকে সঙ্গে নিয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। রাজপথে সন্ত্রাসে নেমে নিরীহ মানুষ আগুনে পুড়িয়ে মেরেও কোনো লাভ হয়নি, বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে।

বর্তমান সরকার নির্দিষ্ট সময়ে সংবিধানের ধারা অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিএনপি বলছেন তারা আন্দোলন করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবি আদায় করবেন। কিন্তু আন্দোলন করার এবং নির্বাচন বর্জন করার পক্ষে জনসমর্থন তাদের আছে কি? বর্তমান সরকারকে অবৈধ সরকার আখ্যা দিয়ে গত চার বছর তারা যা করেছেন, তার কোনোটাতেই তারা সফল হয়েছেন কি? ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের বর্তমান দফায় ক্ষমতায় থাকার চতুর্থ বছর পূর্ণ হয়েছে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার সরকারের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার মওদুদ এবং মির্জা ফখরুল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের প্রতিবাদ করেছেন এবং বলেছেন, তারা আন্দোলন করে দাবি আদায় করবেন। এটা যে দেশের মানুষের সঙ্গে ধোঁকাবাজি তাতে সন্দেহ নেই। রোজই সংবাদপত্রে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে দর কষাকষি প্রকাশ্যেই চলছে। এমনকি এমন খবরও বেরিয়েছে যে, “আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী তালিকায় ১০০ নতুন মুখ খুঁজছেন। জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রবীণ ও নবীন প্রার্থীদের সমন্বয় ঘটাতে চান। প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।” বিএনপি সমর্থক বন্ধুকে বলেছি, বিএনপি এখন মুখে যা-ই বলুক, দলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তারা বর্তমান সরকারের ব্যবস্থাপনার অধীনেই নির্বাচনে যাবে। নইলে দলটি বিভক্ত হবে অথবা বিলুপ্ত হবে। তা আমাদের কারো কাম্য নয়। বিএনপি ষড়যন্ত্রের রাজনীতির পথ ছেড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসুক, এটা আমাদের সবার কাম্য।[লন্ডন, ১৩ জানুয়ারি, শনিবার, ২০১৮]

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn