বিন্দু পেয়ারি হলেও গল্পটা একটুও নয়
ছবিতে আয়ুষ্মান খুরানা বাঙালি লেখক অভিমন্যু রায়। একটি দৃশ্যে অভিমন্যুকে তার এক প্রকাশক বলছে, পাল্প ফিকশনে গুলজারের মতো লিখতে যেও না। নিজের মতো করেই লেখো। ছবির নির্মাতারা যে কেন নিজেরাও এই উপদেশ মানলেন না, কে জানে!
ছবির মুখ্য চরিত্রেরা এমনিতে খামখেয়ালি। অথচ তাদের মুখে কিছু সংলাপ এমন কাব্যিক, যে মানা যায় না। তার মধ্যে রয়েছে অস্তিত্ববাদের ক্রাইসিস থেকে প্রেম নিয়ে অনিশ্চয়তা, মানে এখনকার যুগে শহুরে কমবয়সিদের যা যা সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে, সবের একটা জগাখিচুড়ি। তাও যদি গল্পের বুনন ভাল হতো! কিন্তু গল্প বলার ধরন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে চিত্রনাট্যকার আর গল্পের দিকে মন দিতে পারেননি। তাই চরিত্রগুলোতে প্রাণ থাকলেও, গল্পে তা পাওয়া যাবে না।
শোভাবাজারের পাড়ার বাসিন্দা অভিমন্যু। সব বাঙালির মতোই তার একটা ডাকনামও রয়েছে— বুবলা। ছবির কলাকুশলীর মধ্যে যেহেতু বেশ কিছু বাঙালি ছিলেন, তাই ভিস্যুয়াল রেফারেন্স, প্রডাকশন ডিজাইন বা সংলাপে বাঙালিয়ানা রয়েছে ভরপুর। কিন্তু অপরাজিতা আঢ্য যতই মিষ্টি করে বুবলা বলে ডাকুন, আয়ুষ্মান খুরানার চেহারায় বড্ড উত্তর ভারতীয় ছাপ। কী করে তাঁকে বাঙালি ভাবা যায়!
ছোট থেকেই অভিমন্যু তার পড়শি বিন্দুর প্রেমে পাগল। বিন্দু (পরিণীতি চোপড়া) সেটা ভালই বোঝে। দিব্যি অভিমন্যুকে ‘ফ্রেন্ডজোন্ড’ করে তার ভরপুর ফায়দাও তোলে। তবে সে তো কোনও একজনের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলার মেয়ে নয়। পরিণীতি তাঁর কেরিয়ারে এখনও পর্যন্ত যে ধরনের চরিত্রগুলো বেশি করেছেন, বিন্দুও তেমনই। গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। নিজের মর্জির মালিক। কোনও কাজ শেষ করা তার ধাতে নেই। কিন্তু সে কেন এমন, তার পরিষ্কার কোনও ব্যাখ্যা নেই। তার অ্যালকোহলিক বাবার সঙ্গেও সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি পরিচালক। প্রেমের ক্ষেত্রেও সেই একই রকম খামখেয়ালি। কোনও একজনের সঙ্গে বেশিদিন মন টেকে না। তবে আর পাঁচজন বলিউড হিরোর চেয়ে অভিমন্যু আলাদা। তাই নায়িকার না’কে সম্মান জানিয়েছে। পাগলের মতো তার পিছু নেয়নি। শুধু বহু শহর ঘুরে যখন দু’জনেই মুম্বইয়ের বাসিন্দা হয়ে যায়, তখন অভিমন্যু বাকি সব ভুলে (এমনকী, নিজের সুন্দরী প্রেমিকাকেও) বিন্দুকে সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খুব অল্প সময়ের জন্য তারা ডেটও করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভিমন্যুকে ছে়ড়ে বেঙ্গালুরু পালিয়ে যায় বিন্দু। তারপর থেকেই ভূতের গল্প লেখা শুরু করে অভিমন্যু। প্রত্যেক গল্পে একটা করে ‘ফাম ফাতাল’ থাকে। তারা আবার সকলেই বিন্দুর আদলে তৈরি!
বিন্দুকে অনেকের পছন্দ হতে পারে। তবে এমন চরিত্রে পরিণীতি আগেও দারুণ অভিনয় করেছেন। তাঁর চোখ দু’টো বরাবরই আকর্ষণীয়। কিন্তু কেন যে তিনি বারবার এমন ছবি বাছেন, যার গল্পটা একদমই আকর্ষণীয় নয়, বোঝা মুশকিল। ‘হাসি তো ফাসি’, ‘দাওয়াত-এ-ইশ্ক’, ‘কিল দিল’— কোনও ছবিই দর্শকের মন ছুঁতে পারেনি। রজতাভ দত্ত বা অপরাজিতা আঢ্য কোন মাপের অভিনেতা তা বাঙালি দর্শকের অজানা নয়। তবে এবার সর্বভারতীয় দর্শক দেখতে পাবেন, ছোট চরিত্রেও অভিনয় করেও কেমন গোল দিতে যায়! আরও কিছু ছোটখাটো ক্যামিওতে রয়েছে বাংলার অনেক পরিচিত মুখ। তবে ‘কহানি’তে শাশ্বত-পরমব্রতদের দেখে যতটা আনন্দ হয়েছিল, ততটা এবার হবে না। কারণ পরিচালক-গল্পকাররা সেই সুযোগটা দিলেন না।
গান এই ছবির একটা বড় অংশ। বিন্দু-অভিমন্যু জীবনের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত মিক্সড টেপে বন্দি করে রাখে। গল্প লেখার অনুপ্রেরণা হিসেবে সেই নব্বই দশকের ক্যাসেটগুলোই ভরসা অভিমন্যুর। টেপ রেকর্ডার, পুরনো হিন্দি সিনেমার গান, নব্বই দশকের কিছু পরিচিত ছবি— সব মিলিয়ে একটা নসট্যালজিক সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পরিচালক। কিন্তু সেই দিকটাও খুব একটা জমল না। বিশেষ করে যাঁরা নব্বইয়ের দশকে বড় হয়ে উঠেছেন, তাঁরা বিন্দুর সাজপোশাক দেখে অবাক হয়ে ভাববেন এ ধরনের মেয়েদের তো আশপাশে দেখা যেত না! বা কলকাতায় রাত ১টার পর কোন ট্রাম ডিপোয় এমন হিপহপ ডান্স কালচার চলত!
ছবির শেষে অভিমন্যুর প্রথম লাভ স্টোরি পড়ে বিন্দু বলে, আমি গল্পটা বললে অন্য রকম হতো। শুনে দর্শকের আফশোস –হতে পারে। কেন সেটাই পরদায় দেখা গেল না!