বিশিষ্টজনদের মত ক্রয়ফায়ার সমাধান নয়
মরিয়ম চম্পা-সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার পর দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় দেশের সর্বত্র ধিক্কার ও ক্ষোভ চলছে। এ ধরনের ঘটনা থামাতে কঠোর শাস্তি প্রয়োগের কথা বলছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন, ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের ক্রসফায়ারে দেয়া উচিত। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রসফায়ার কোনো সমাধান নয়। এ ধরনের ঘটনা থামাতে হলে দ্রুত বিচার করে প্রচলিত আইনেই শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। যেকোনো অপরাধ যদি কেউ করে তাহলে প্রমাণসাপেক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকে না।
এ ধরনের অপরাধগুলো জঘন্য- এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার জন্য তদন্ত হবে এবং খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিচার প্রক্রিয়া যেন না হয়। খুব কম সময়ের মধ্যে ঘটনার তদন্ত শেষ করে থানা থেকে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেবে। আদালতে বিচার যখন শুরু হবে কোনোরকম মুলতবি হবে না। যত দ্রুত সম্ভব এক থেকে দুই মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে। এটা হলে বিচারহীনতার যে একটি সংস্কৃতি এটা আর থাকবে না। তখন মানুষ সতর্ক হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একটি অন্যায় বন্ধ করতে আরেকটি অন্যায় সংঘটিত করা কোনো সমাধান নয়। আমাদের দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থাকায় অন্যায় করে তারা পার পেয়ে গিয়েছে। এটা বন্ধ করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া বন্ধ করতে হবে। এবং আমাদের মূল্যবোধ জাগ্রত করতে সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন এবং সরকারকে সমন্বিতভাবে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ক্রসফায়ার সমাধান নয়। কারণ, যখনই ক্রসফায়ারের কথা আমরা বলি এই ক্রসফায়ারটা পরবর্তীতে ব্যবহার করা হয় সাধারণ ও সরল প্রকৃতির মানুষের ক্ষেত্রে, পুলিশের চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করাসহ অন্যান্য অনৈতিক কাজে। কোনোভাবে যদি ক্রসফায়ারের পক্ষে বলি তাহলে ওই কাজগুলোকেও বৈধতা দেয়া হয়। এখন বাংলাদেশে কোনো আইনে কি বলা আছে ক্রসফায়ার করা যাবে? এগুলো সংবিধানবিরোধী কথা। এখন সমাধানটা কি? এদেরকে (দোষীদের) দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। মাঝে মাঝে দেখি কোনো কোনো ধর্ষক বা অপরাধীকে অবৈধ অস্ত্র রাখায় পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। এটা দেখলেই মনে হবে তাড়াতাড়ি শাস্তি দেয়ার জন্য করেন। কারণ অবৈধ অস্ত্র রাখলে শাস্তি দেয়া খুবই সোজা হয়। এখন ধর্ষণের শাস্তি যেন সোজা হয়। এবং দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের ফরেনসিক সাপোর্ট খুবই দুর্বল। একজন নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হলে সেটা প্রমাণ করাটা খুবই কঠিন। এবং সেখানে অনেক দুর্নীতি হয়। ক্ষমতাধর লোকেরা ফরেনসিক প্রতিবেদন উল্টে দেয়। এগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। পুলিশ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী সর্বত্র যেন কোনোরকম দুর্নীতি না হয়। বিচারের প্রক্রিয়া সংক্ষেপ করতে হবে। দ্রুত বিচার করতে হবে। একাধিক ফাঁসির রায় কার্যকর হলে দেখা যাবে এগুলো আর হবে না। আমাদের দেশে এসিড সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ার পর কড়া আইন হওয়ায় ঘটনা প্রচণ্ড কমে গিয়েছিল। একইসঙ্গে অপরাধীর উৎসস্থলকে চিহ্নিত করে ক্ষমতার বিকাশ রোধে পেছনের গডফাদারদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশে জবাবদিহিতামূলক শাসন ব্যবস্থা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের মন্ত্রীরা বলে থাকেন সব দেশে ধর্ষণ ও দুর্নীতি হয়। এটা অত্যন্ত অবিবেচকসুলভ এবং আত্মঘাতী কথাবার্তা। এগুলো বন্ধ করা দরকার। পৃথিবীর সব দেশে অপরাধ হয় এবং সব সভ্য দেশে বিচার হয়- আমাদের এখানে বিচার হয় না- এটা বলতে হবে। এই বিচারহীনতাকে ভাঙতে হবে।
লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, কোনো ক্ষেত্রেই ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করবো না। ক্রসফায়ার কখনোই সমর্থন যোগ্য নয়। তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য। এই যে নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং হত্যা করা হয় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যদিও আমাদের যে বিচারিক দীর্ঘ প্রক্রিয়া তাতে অনেক সময় লাগবে। সেজন্য আমরা যেটা চাই যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া। বেশিদিন হয়ে গেলে এটার তাৎক্ষণিকতা থাকে না। সাক্ষী যোগাড় করাসহ নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। কাজেই আমি মনে করি দ্রুত বলতে বেশি হলে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে।
আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুঁথি বলেন, একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পরে আমরা প্রথমদিকে খুব সচেতন হই। আন্দোলন ও প্রতিবাদ করি। কিছুদিন আগেও হয়েছিল। তাছাড়া ধর্ষণের কোনো ঘটনা যখন আলোচনায় আসে তখন একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে থাকে। এবং বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। অন্যান্য সময় এটা দেখা যায় না। ধর্ষণ বন্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ার কোনো সঠিক পথ নয়। একটি অপরাধ বন্ধ করার জন্য আমি আরেকটি অপরাধকে কখনো সমর্থন করতে চাই না। ক্রসফায়ারের মাধ্যমে একজন অপরাধীকে মারতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে নিরপরাধ আরো এক শ’ জনকে আমি মেরে ফেলছি। এবং বিচার প্রক্রিয়া যখন জনগণের হাতে চলে যাবে সেটা আমরা দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনতে পারবো না। ধর্ষকের ক্রসফায়ারে কখনো বিচার হয় না। বিচার হতে হবে বিচারিকভাবে আইন-আদালতের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা শেষ করতে হবে। অনেক সময় আমরা দেখি যে, মামলা যখন চলে তখন এতো ফাঁকফোকর থেকে যায় যে, ধর্ষক পার পেয়ে যায়। এখানে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশকে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করতে হবে। যাতে অপরাধী আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেয়ে যেতে না পারে। মোটকথা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।