বিয়ানীবাজারের খালেদের দুঃসহ ইউরোপ যাত্রা
বাংলাদেশিদের কাছে ইউরোপের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। এক আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে এমন স্বপ্নময় যাত্রা। পথে দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতিত হচ্ছে তারা। তাদেরকে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। একবার নয়। তিন বার পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়া হয়। তারপর অনিশ্চিত সমুদ্রযাত্রা। তাতে প্রাণহানি হচ্ছে অনেকের। কেউবা কোনোমতে জীবন ফিরে পান। তবে তাদের পেছনে থেকে যায় এক ভয়াবহ অতীত। তারা দেখতে পান, সঙ্গীদের ডুবে মরার দৃশ্য। এ এক লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। এমনই অভিজ্ঞতার অধিকারী সিলেটের বিয়ানীবাজারের খালেদ হোসেন অন্যতম। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। এতে খালেদের কাহিনী তুলে ধরা হয়। তার চোখের সামনে উত্তাল সমুদ্রে পানিতে ডুবে মারা গেছে তার এক কাজিন। সেই ভীতিকর দৃশ্য তাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তারা লিবিয়া থেকে ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালির উদ্দেশে ভেসেছিলেন প্লাস্টিকের বোটে। কিন্তু সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তার মতো দক্ষিণ এশিয়ার এই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার যুবক পাড়ি দিচ্ছে লিবিয়ায়। তাদের স্বপ্ন থাকে দুর্বিষহ সমুদ্র যাত্রার মাধ্যমে ইতালি পৌঁছা। খালেদ হোসেন বলেছেন, লিবিয়া থেকে যাত্রার পরে যখন জানতে পারলাম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইতালি পৌঁছে যাবো তখন আনন্দে মনটা নাচছিল। একবার ইতালি পৌঁছতে পারলে আমার পরিবারের সব আর্থিক সঙ্কট কেটে যাবে। আমি ভাবলাম, এর মাধ্যমে আমার প্যারালাইসিসে আক্রান্ত পিতার কাছে নিজেকে অর্থপূর্ণ হিসেবে প্রমাণ করতে পারবো। কিন্তু ইতালির বন্দরে পৌঁছার আগেই অনেককে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। আর যারা বন্দর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, তাদের সলিল সমাধি হয়। এভাবেই মারা গেছে আমার এক কাজিন। এজন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তার মৃত্যুর বিভীষিকা আমাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। উল্লেখ্য, কাজিন ফরিদকে সঙ্গে নিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে ছোট্ট এক প্লাস্টিকের বোটে উঠেছিলেন খালেদ। তিনি বলেছেন, ওই বোটে গাদাগাদি করে উঠেছিলেন শতাধিক মানুষ। তার মধ্যে বেশির ভাগই আফ্রিকান। তবে তার মধ্যে বিয়ানীবাজারের ছিলেন কয়েক ডজন মানুষ। এ ছাড়া ছিলেন দেশের অন্যান্য স্থানেরও কেউ কেউ। ওই বোটটি ছিল ত্রিশ ফুট লম্বা। লিবিয়া থেকে ছেড়ে যায় তা। অনেকটা সময় চলার পর তা ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যেতে থাকে বোট। খালেদ হোসেন বলেন, তখন এক ভয়ানক পরিস্থিতি। আর্তচিৎকার শুরু হয়। নিশ্চিত মৃত্যু জেনে আল্লাহ্কে ডাকতে থাকে সবাই। খালেদ বলেন, তার সামনে বাংলাইেশ এক যুবককে ভিড়ের ভিতর মারা যেতে দেখেছেন। বোটের অন্য যাত্রীরা আতঙ্কে লাফিয়ে পড়তে থাকেন সমুদ্রে। তাদেরকে আর কখনো দেখা যায়নি। বোটে থাকা পেট্রোলের কয়েকটি ড্রাম কেউ কেউ বোটের ভিতরই ঢেলে তা খালি করে ফেলেন। তারপর তা পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে তা ধরে বাঁচার চেষ্টা করেন। খালেদ বলেন, বোটে আগুন লেগে যায়। এর ভিতরে পেট্রোল ঢেলে দেয়ায় আগুন তাতে ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে। এ সময় তার কাজিন ফরিদ লাফিয়ে পড়ে সমুদ্রে। সে দূরে একটি জাহাজ দেখে সাঁতরাতে থাকে সেদিকে। আশা- তাকে উদ্ধার করবে। কিন্তু তার সে আশা সফল হয়নি। খালেদ বলেন, এক সময় আমি দেখতে পেলাম প্রাণহীন ফরিদের দেহ পানিতে ভাসছে। উল্লেখ্য, এ বছর এ পর্যন্ত ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কমপক্ষে ২৭০০ মানুষ মারা গেছে জাতিসংঘের হিসাবে। যাদেরকে উদ্ধার করা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো বাংলাদেশি। খালেদ হোসেন বলেছেন, তাকে সমুদ্র থেকে তুলে নিয়ে যায় লিবিয়ার একটি গ্যাং। তাদের অধীনে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে দাসের মতো অবস্থায় থেকে তাকে তিন মাস কাজ করতে হয়েছে। এ সময়ে তাকে কমপক্ষে তিনবার বিক্রি করা হয়েছিল। মারাত্মক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকা তার পিতা তাকে মুক্ত করতে মুক্তিপণ হিসেবে পরিশোধ করেন ১২০০০ ডলার। এরপরই মুক্তি পান খালেদ। তিনি বলেছেন, আমাদের ওপর নির্যাতন করা হতো। নারীদের ধর্ষণ করা হতো। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বলাৎকার করা হতো যুবকদের। এমন অবস্থায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়া বাংলাদেশের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছেই। ২০১৪ সালে কয়েক ডজন বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের জুন থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০০০। এ তথ্য সরকারি সূত্রের। তবে কোনো কোনো হিসাবে এ সংখ্যা ৩০০০০ পর্যন্ত বলা হয়। শুধু বিয়ানীবাজারের প্রায় ১০০০ যুবক গত এক বছরে এভাবে ১০ হাজার ডলারের বিনিময়ে ইউরোপ সফরে গিয়েছেন। এ তথ্য স্থানীয় কাউন্সিল চেয়ারম্যান আতাউর রহমান খানের। তিনি বলেন, যুবকরা লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য বেপরোয়া। এজন্য পিতা অর্থ ধার করেন। মা তার সবটুকু বিক্রি করে দেন। সবটুকু অর্থ এক করে তারা পাচারকারির হাতে তুলে দেন। কিন্তু পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। কারণ, মিয়ানমারের রাখাইনে নৃশংসতার শিকার হয়ে সব মিলিয়ে কমপক্ষে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ২৫শে আগস্টের পর তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ৫ লাখ ৩৬ হাজার। এসব রোহিঙ্গা স্থানীয় কর্মক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। ফলে বাংলাদেশে সম্পদের যেখানে মারাত্মক ঘাটতি আছে, সেখানে এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বোঝা হয়ে থাকলে তাতে স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। সরকার এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য কক্সবাজারে বিশাল এলাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মাধ্যমে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। অভিবাসন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জালাল উদ্দিন শিকদার বলেছেন, সরকার যদি রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান পেতে ব্যর্থ হয় তাহলে পরিস্থিতি বাংলাদেশের ভিতরে বা বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি বলেন, পাচারকারিরা খুব কমই ইউরোপে মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রে সফল হয়। তবে তারা হাজার হাজার যুবককে প্রলুব্ধ করে। তারা যুবকদের স্বপ্ন দেখায়। প্রলোভন দেয় ভালো চাকরির। এতে পরিবারের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। আর পরিণামে ভূ-মধ্যসাগরে ডুবে শেষ পরিণতি ঘটে স্বপ্নের।