‘বোবার পৃথিবী’ বা ‘কবরের নীরবতা’ কারোরই কাঙ্ক্ষিত নয়!
আমাদের দেশে বড় সমস্যা হচ্ছে, এখানে একইসঙ্গে সৎ সাংবাদিকতা যেমন হচ্ছে, অপসাংবাদিকতাও হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার এক কলামিস্ট বন্ধু যথার্থই মন্তব্য করেছেন: ‘‘চাইলে প্রতিদিনই কোনও না কোনও সাংবাদিক/ সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কারণ, অপসাংবাদিকতা বা দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা তো হচ্ছে। হচ্ছে ব্যাপকভাবে। উদ্দেশ্যমূলক, এমনকি অপরাধমূলক সাংবাদিকতাও হচ্ছে। কথা হলো অপসাংবাদিকতা ঠেকাতে গিয়ে যদি পুরো সাংবাদিকতা পেশাকেই ভীতি ও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কি সমাজের জন্য ভালো হবে?
আমাদের দেশে সাংবাদিকতা জগতে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি-সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের সার্বিক ভূমিকা ইতিবাচক। জনগণের ভরসার জায়গা এখনও গণমাধ্যম। আগের চেয়ে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা হয়তো কিছুটা কমেছে। কিন্তু একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আগে আরও বেশি করতো, যদিও তখন এ পেশায় ‘গ্ল্যামার’ ছিল না। ‘অ্যাফ্লুয়েন্স’ বা সমৃদ্ধি এলেই মানের উন্নতি হবে, এমন কোনও কথা নেই। সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহলে দেশে জঙ্গিবাদ বাড়ত না। সংবাদপত্র তথা মিডিয়ায় বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীলতা বাড়বে বলে যারা ভেবেছিলেন, তারাও ভুল প্রমাণ হয়েছেন।
যাহোক, সরকারের উচিত হবে না খালি দু-একটি স্পর্শকাতর ঘটনায় রিঅ্যাক্ট করা। পারলে এর সার্বিক মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখাই তার কর্তব্য। তেমন মনোভাব অবশ্য কখনোই সরকারের দিক থেকে দেখতে পাইনি। তারচেয়ে বড় আর বেদনার কথা, সাংবাদিক কমিউনিটির ভেতরেও এ বিষয়ক ভাবনাচিন্তা সেভাবে দেখতে পাচ্ছি না। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লোক হয়তো আক্ষেপ করে মরছে।’’
আমার বন্ধুর উল্লিখিত মন্তব্যটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। মিথ্যা-বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন, অপসাংবাদিকতা, হলুদ সাংবাদিকতা করা উচিত কিনা সেটা যেমন সংশ্লিষ্ট সকলের ভেবে দেখা দরকার, পাশাপাশি সরকারেরও সমালোচনা হজম করার শক্তিটা আরও বাড়ানো দরকার। কেউ কিছু বললেই কেন তাকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে উঠেপড়ে লাগতে হবে? সবাইকে কি আর আইন আর শাস্তির ভয় দেখিয়ে সোজা করা যাবে? না তা-ই উচিত? আসলে আমাদের সবার শুভবুদ্ধির উন্মেষ বড় বেশি প্রয়োজন!
আর শুধু সাংবাদিকতা নয়, আমাদের প্রত্যেকের আচার-ব্যবহার, লেখালেখি, শব্দচয়ন, বাক্য ব্যবহার এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। অন্যের ক্ষতি হয়, কারও মনে আঘাত লাগে, সামাজিক স্থিতি বিনাশ হয়, এমন কিছু করা বা বলা আমাদের কারোরই উচিত নয়। আবার এর ভিন্ন দিকও আছে। এই আশঙ্কাও হয়, ‘দায়িত্বশীল’ হতে হতে, বুঝতে বুঝতে, শব্দ-বাক্য-গলা হ্রস্ব করতে করতে আমরা আবার বোবা হয়ে যাবো না তো?
বিষয়টি কিন্তু খুব সরল নয়। গভীরভাবে ভেবে দেখলে, আমরা কিন্তু অনেক কথাই বলি, যা বলা উচিত নয়। আমরা অনেক কথা বা শব্দই লঘুভাবে ব্যবহার করি, যার সঙ্গে মানুষের অসহ্য যন্ত্রণা জড়িয়ে আছে। যদি কেউ বলে, ‘উফ, ওর চাউনি আমার বুকে ছুরি বসিয়ে দিলো’, তা হলে, সত্যিই বুকে ছুরি খাওয়া মানুষের তীব্র শারীরিক (মানসিকও, কারণ সে তুমুল ভয় পাচ্ছে, আর বাঁচবে না) যন্ত্রণাকে কী চূড়ান্ত অপমান করা হলো না- কথাটা জাস্ট একটা মুগ্ধতার অনুষঙ্গে ব্যবহার করে ফেলে?
‘ক্রিস গেইল কী ব্যাট করছে রে, পাগলের মতো চার-ছয় মারছে’, এই বাক্যে, মনোরোগীদের এলোপাতাড়ি ব্যবহারের মূলে যে অসুস্থতা, তার প্রতি অপমান নেই? যদি বলি ‘বাংলা শিল্প বামনে ছেয়ে গেছে’, তখন কি ভার্টিকালি চ্যালেঞ্জড মানুষদের অপমান করি না? যখন রবীন্দ্রনাথ প্রেম বোঝাতে লেখেন ‘আমি জেনে-শুনে বিষ করেছি পান’, তখন কি তিনি, যারা সত্যিই জেনে-শুনে বিষ পান করেছে, তাদের বিষটা খাওয়ার আগে যে তুলকালাম বিষাদ ও অভিমান; তাদের বিষ খাওয়ার সিদ্ধান্তে আসার পথে পেরোতে হয়েছে যে অবর্ণনীয় কষ্টের দিনরাত্রি; এবং বিষটা খাওয়ার অব্যবহিত পরে তাদের কণ্ঠনালী অন্ত্র ও পেটের যে দাউ দাউ শরীর-তড়পানি-এই সবকিছুকে অপমান করলেন না?
ঝগড়া করতে গিয়ে বউ যখন বলল, ‘এ সংসারে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে’, তখন সে কি, যাদের সত্যি সত্যি দম বন্ধ হয়ে আসে লোহা-আঙুলের চাপে, বা দড়ির ফাঁসে, বা হার্ট অ্যাটাকে, তাদের অক্সিজেনের জন্য আকুল ছটফট বায়োলজিক্যাল কষ্টটা আন্দাজ করে, মনে মনে সেই কষ্টের সঙ্গে নিজের মানসিক কষ্টটাকে ওজন করে, তারপর কথাটা বলেছে?
কেউ যদি কাউকে দেখে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করে যে, ‘ওরে বাবা, কী হাড্ডিসার চেহারা, এ তো যেন সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট!’ তাকে তিরস্কার করে মানবাধিকারকর্মী বলবেন, যে দেশে অবিশ্বাস্য দুর্ভিক্ষে বছরের পর বছর লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন, সে দেশের অনাহার ও অপুষ্টিজনিত শীর্ণতাকে ব্যঙ্গের উপাদান করার চেয়ে নিষ্ঠুর আর কিচ্ছু হতে পারে না, কিচ্ছু না!
কোনও সন্দেহই নেই, কাউকে আঘাত না করা খুবই ভালো। কোনও কথায় যদি কারও যন্ত্রণাকে ছোট করা হয়, সে কথাটা না বলাই ভালো। কিন্তু তা হলে এই পৃথিবীতে কথা বলা যাবে কি? সমস্ত স্বতঃস্ফূর্তির মুখে পাথর চাপা দিয়ে একটা পলিটিক্যালি কারেক্ট পৃথিবী তৈরি করে তাতে বৃক্ষের মতো আড়ষ্ট বেঁচে থাকা, দমন-পীড়নের ভয়ে আঁটোসাঁটো বাঁচা কি চমৎকার হবে? অনেকে বলবেন, সেটা এখন খুব অ্যাবসার্ড মনে হলেও, আস্তে আস্তে শিখে নিতে হবে, এবং একবার আয়ত্ত হয়ে গেলে ওটাই স্বতঃস্ফূর্তির স্রোতটা পেয়ে যাবে আর ওর মধ্য দিয়েই দিব্যি আনন্দ ঝলকাবে!
কিন্তু তা বোধহয় একটা তাত্ত্বিক সম্ভাবনা বই আর কিছুই নয়। মানুষের ভাষা বাধ্যতামূলকভাবে শুধু ঔচিত্যকে ভজনা করতে শুরু করলে, পৃথিবী থেকে প্রায় সব আনন্দই উবে যাবে। পর্নোগ্রাফি, চুটকি ও গালাগালি তো উধাও হবেই (কারণ, এদের মূল রসটাই উৎসারিত হয় অসমীচীনতা থেকে), বিশ্বসাহিত্যের অনেকটাই বাতিল হয়ে যাবে। রূপকথা তো একেবারে প্রথমেই ডাস্টবিনে, কারণ তারমধ্যে অন্যায়ের ছড়াছড়ি (প্ররোচনাহীনভাবেই নেকড়ে এসে ঠাকুমা ও নাতনিকে খেতে চাইছে, রাজপুত্র শুধু নিজের লাভের জন্য রাক্ষসের প্রাণভোমরা টিপে মারছেন, রূপবান ও রূপবতীকেই কাঙ্ক্ষিত ভাবা হচ্ছে)।
আড্ডা বলে তাহলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব থাকবে বলে মনে হয় না। এমনি পত্রপত্রিকায়ও এমন হেডলাইনও লেখা যাবে না: ‘রাজধানীতে মশার উপদ্রব বাড়লো’। কারণ, মশা তো ‘উপদ্রব’ করেনি, সে তার স্বাভাবিক খাদ্য আহরণের চেষ্টা করেছে মাত্র। তাই প্রকৃত সতর্ক ও যথাযথ হেডলাইন হওয়া উচিত: ‘রাজধানীতে মশার সংখ্যা বেড়ে গেছে, এবং তারা খাবার পাওয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে কামড়াচ্ছে, এবং যদিও তাদের সংখ্যা বাড়ার পেছনে তাদের সচেতন চক্রান্ত নেই এবং মানুষের কী ক্ষতি তারা করছে তাও বোঝার ক্ষমতা নেই।
মানুষ এই সভ্যতা স্থাপন করেছে বলে মানুষই সব ব্যাপারে অগ্রাধিকার পাবে ও অন্য প্রাণীর অধিকার সম্পর্কে নির্লিপ্ত বা অবজ্ঞাময় থাকবে—তাও এক অন্যায়। বরং ক্ষমতা যত বাড়ে ততই অন্যের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হওয়ার দায়িত্বও বাড়ে এবং কামড়ের বিরক্তি সহ্য করতে না পেরে মশার প্রাণ হরণ করলে তা সামান্য কষ্টের বাড়াবাড়ি প্রতিক্রিয়া বলেই প্রতিভাত হতে পারে। তবু, মানুষের সভ্যতায় অমন সামগ্রিক ঔচিত্য বজায় রাখতে গেলে একসময় বাঁচা দায় হয়ে পড়বে বলে লিখি, ‘রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেড়েছে।’
না, বলছি না, চলুন সব সময় পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা বলি ও আনন্দে নৃত্য করি। চলুন সত্যমিথ্যা মিলিয়ে ক্ষমতাসীনদের কথা বলি। নারী-আদিবাসী-হিজড়া, সমকামীদের অপমান করে কৌতুক বা চুটকি তৈরি করি, আর কেউ প্রতিবাদ করলে বলি, ব্যাটা খিঁচে দিল, বেরসিক! বলছি, কেউ কোনও কথা বললে, ইনটেনশনটা আগে বোঝার চেষ্টা করা দরকার। বোবার শত্রু নেই। সবকিছু থেকে রেহাই পাওয়া যায়, কথাবার্তা বন্ধ করে দিলে। কোনও কিছু না বললে, না লিখলে। কিন্তু ‘বোবার পৃথিবী’ বা ‘কবরের নীরবতা’ নিশ্চয়ই আমাদের কারোরই কাঙ্ক্ষিত নয়!
লেখক: কলামিস্ট.
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। সুনামগঞ্জ বার্তা অনলাইন সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার সুনামগঞ্জ বার্তা অনলাইন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।