ব্যাংকের দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাট পরিচালনা পর্ষদই ৯০ শতাংশ দায়ী
অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলো দেড়শ’ কোটি থেকে ৪শ’ কোটি টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছে। তারা কি আলাউদ্দিনের চেরাক পেয়েছে নাকি। মূলত উচ্চ সুদ ও মাত্রাতিরিক্ত সার্ভিস আরোপ করে মুনাফা করছে। শহরের বড় বড় ব্যবসায়ীকে নিয়ে ব্যবসা করলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো গ্রামে শাখা খুলছে না। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকের ২৯শ’ কোটি টাকা এখনও আদায় করা সম্ভব হয়নি। ৭০ থেকে ৭১ জনের হাতে এ টাকা রয়েছে। একজন চেয়ারম্যানের (শেখ আবদুল হাই বাচ্চু) কারণে আজ এ অবস্থা। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রমাণ রয়েছে। সংসদীয় কমিটি এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে। আজ পর্যন্ত সরকার ও দুদক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। তিনি ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।
কর্মশালায় ব্যাংকের নীতি ও বিধানগুলো কমপ্লায়েন্স করার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ঋণ প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ে ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের টায়ার (মূলধনের স্তর) হ্রাস, স্বচ্ছতা নিশ্চিত, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শাস্তি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর সীতাংশু কুমার সুর চৌধুরী বলেন, বর্তমান মন্দ ঋণ আদায়, সঠিকভাবে ঋণ বিতরণ ও সুশাসন নিশ্চিত করাই ব্যাংকগুলোর বড় চ্যালেঞ্জ। মন্দ ঋণ আদায়ে উৎসাহিত করতে প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের জন্য নগদ প্রণোদনা ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ঋণ মঞ্জুরকারী কর্মকর্তার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। এসকে সুর চৌধুরী বলেন, ঋণ নিয়ে অনেকে ভিন্ন খাতে ব্যবহার করছে। অর্থ পাচার হচ্ছে। এসব বিষয়ে মনিটরিংয়ের জন্য পৃথক একটি বিভাগ থাকতে পারে। ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগ শক্তিশালীসহ ঋণ সম্প্রসারণে কম নজর দেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন তিনি।বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ লোকজন ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে। এতে ঋণ পেয়ে তারা পরিশোধ করছে না। এদিকে নজর দিতে হবে।
আইডিআরএ সদস্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস বলেন, সরকার কিভাবে ব্যবসা করে এর মডেল ছিল বেসিক ব্যাংক। কিন্তু একজন ব্যক্তির কারণে ব্যাংকের আজ এ অবস্থা। পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার কারণেই ব্যাংকটির এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, হলমার্ক ইস্যু প্রথমে শনাক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে। এরপর সোনালী ব্যাংক এ ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ দেয়। কিন্তু ২০১১ সাল পার হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ২০১২ সালের মার্চ মাসে এসে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮ দিন আগে তা বাতিলের সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ২০১১ সালে হলমার্কের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লোজ মনিটরিং করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। হলমার্কের ভুয়া কেওয়াইসি (গ্রাহকের পরিচিতি ও সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের আর্থিক বিবরণী) ওপর ২০টি ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। কিভাবে এই ঋণ দেয়? তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গকুল চাঁদ দাস বলেন, খেলাপি হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভুল পদ্ধতিতে জামানত রেখে ঋণ দেয়ার কারণেই খেলাপির হার বাড়ছে। ঋণের জামানত হিসেবে জমি দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা বিক্রি করে টাকা আদায়ের নজির নেই কোনো ব্যাংকের।
তিনি আরও বলেন, ঋণ আদায়ে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের (সিইও) আরও বেশি নজর দিতে হবে। এতে আদায়ের হার ভালো হবে। এমডিদের পারফরম্যান্স অডিটের আওতায় আনা দরকার। প্রতি তিন মাসের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হলে এমডিদের শাস্তি হিসেবে বেতন কেটে রাখা এবং পরপর চারবার বেতন কাটা হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধান চালু করতে হবে। খেলাপিদের কাছ থেকে আদায়ের অর্থ দিয়ে নতুন করে ঋণ দিতে হবে এমন বিধান চালু করা দরকার। কারণ মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে এমডি নিয়োগ দেয়া হল। কিন্তু ব্যাংকের উন্নতি হল না- এমন এমডি রাখার দরকার নেই।
বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, ব্যাংকের দুর্নীতি ও বড় ঘটনার জন্য ৯০ শতাংশ দায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও বেসিক ব্যাংকের ঘটনা পর্যালোচনা করলে তা দেখা যাবে। এ জন্য ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখেশুনে দিতে হবে। নিয়োগের জন্য তদবির আসবে। এজন্য একটি মাপকাঠির নিচে নামা যাবে না। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরও বলেন, এমন লোকজনকে ব্যাংকের এমডি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, যাদের বাজারে বদনাম আছে। এদের অপকর্মের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের বের করে দেয়া উচিত। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। ভালো মানুষ বসিয়ে দিন। দেখবেন ব্যাংক ভালো চলবে। ব্যাংকের এমডিরা যাতে নয়ছয় করতে না পারে সেদিকে নজর রাখুন।
তিনি দুদকের উদ্দেশে বলেন, ঋণ পুনঃতফসিল করার পরও তাকে আটক করা হচ্ছে। আগে ব্যাংক বাঁচাতে হবে। ঋণ গ্রহীতাকে জেলে ঢুকালে ব্যাংক টাকা পাবে না, তার প্রতিষ্ঠানের লোকজনও বেকার হবে। এসব বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান বলেন, মন্দ ঋণ আদায়ে একটি মামলা করা হলে এর বিপরীতে ২ থেকে ৪টি রিট হচ্ছে আদালতে। তবে মন্দ ঋণের প্রভাব ব্যাংকের আমানতের ওপর না পড়ে সেদিকে নজর রাখতে হবে।অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অবদান রাখতে গিয়ে ব্যাংকের পারফরম্যান্স খারাপ হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এই ব্যাংকের পাওনা ১৫শ’ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে ৪শ’ কোটি টাকা অবলোপন করতে হয়েছে। তবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদ একসঙ্গে কাজ করলে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব। তিনি বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। পদোন্নতিতে প্রভাবশালীদের তদবির থাকে। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগ্যতার মূল্যায়ন হচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে দুদকের সচিব শামসুল আরেফিন বলেন, ব্যাংক ঋণ মনিটরিংয়ের জন্য একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল দরকার। সেখান থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার বিষয়ে মনিটরিং করা হবে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক ঋণের অর্থ প্রকৃতভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে না। অনেক অর্থ পাচার হচ্ছে। এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। কর্মশালায় আরও বক্তব্য রাখেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, রূপালী ব্যাংকের সিইও আতাউর রহমান প্রধান, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন প্রমুখ।