একটা সত্য গল্প। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু গিয়েছেন জেনারেল থিমায়ার কার্যালয়ে। থিমায়া তখন ভারতের সেনাপ্রধান। নেহরু দেখতে পান সেনাপ্রধানের ডেস্কের পেছনে একটি স্টিলের আলমারি। দেখেই থিমায়াকে নেহরু জিজ্ঞেস করলেন, এটার ভেতরে কী? জেনারেল উত্তর দিলেন, প্রথম ড্রয়ারে আছে দেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা। দ্বিতীয় ড্রয়ারে আছে দেশের শীর্ষ জেনারেলদের ব্যাপারে গোপনীয় নথিপত্র। নেহরু জানতে চাইলেন, আর তৃতীয় ড্রয়ারে? অনেকটা হাসি চাপা দেয়ার মতো মুখ করে সেনাপ্রধান বললেন, এই ড্রয়ারে আছে আপনার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে আমার গোপন পরিকল্পনা। উত্তর শুনে নেহরু হেসেছিলেন। কিন্তু তার হাসিতে সেদিন কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাও ছিল।
উপনিবেশ পরবর্তী যুগে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্র যেন একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভারতে সেনাশাসনের সম্ভাবনা শূন্য ছিল না। এমনকি ১৯৬৭ সালের নির্বাচন কভার করতে এসে বৃটেনের টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক নেভাইল ম্যাক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই নির্বাচনই হতে পারে ভারতের সর্বশেষ নির্বাচন। শুধু ম্যাক্সওয়েলই নন। তখন অনেকেই বিশ্বাস করতেন, আজ হোক কাল হোক ভারত সামরিক শাসনাধীন হয়ে পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কিছুই হয়নি। কিন্তু কেন?
ভারতের সেনাবাহিনী কেন কখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেনি, এই প্রশ্নের উত্তরে এটাই বলা হতো যে, এই বাহিনী সুশৃঙ্খল, খুবই পেশাদার এবং বৃটিশদের কাছ থেকে পাওয়া আড়াইশ’ বছরের ঐতিহ্য তাদের মধ্যে প্রোথিত। কিন্তু এই থিওরি বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও একই ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। কিন্তু তবুও তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে কসুর করেনি। অনেকে এমন যুক্তিও দেখাতে পারেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীই বরং এত পেশাদার যে, তারা যখন মনে করলো দেশের অবস্থা এত বাজে যে, হাত গুটিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখার সময় আর নেই। হস্তক্ষেপ করাটাকে তখন তারা নিজেদের দায়িত্ব ভেবে নিল। এ কারণে বলতে হয়, এটি এমন একটি প্রশ্ন, যেটি নিয়ে আরো গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করা উচিত। আর নিজের বই ‘আর্মি অ্যান্ড ন্যাশন’-এ ঠিক সেই কাজটিই করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টিভেন উইলকিনসন।
ভারতে আসলে কী ঘটেনি, সেটি বুঝতে হলে সম্ভবত এটি বোঝা জরুরি যে, পাকিস্তানে আসলে কী ঘটেছিল। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরতান্ত্রিকদের ইতিহাস বেশ আগ্রহোদ্দীপক। অবিভক্ত ভারত থেকে এই ইতিহাসের শুরু। তখন অবিভক্ত পাঞ্জাব ছিল সেনাবাহিনীর সর্ববৃহৎ অঙ্গ। তাই দেশভাগের সময় পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে বৃটিশদের কাছ থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান পেয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে স্বতন্ত্র ও উল্লেখযোগ্য ছিল সেনাবাহিনী। অপরদিকে ভারতে যেখানে কংগ্রেস পার্টি ছিল বিকশিত হওয়া একটি টেকশই সংগঠন, পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ‘জিন্নাহ ও তার ব্যক্তিগত সহকারী’র চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। এ কারণেই পাকিস্তানে একটি বিপজ্জনক কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা ছিল, বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর মৃত্যুর পর।  পাকিস্তানে সামরিক স্বৈরতন্ত্র-শূন্য উদিত হয়নি। যেমন, পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে, লাহোরে দাঙ্গা বাঁধল। এই দাঙ্গা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়লো, কারণ সেখানকার বেসামরিক কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনীকে তলব করা হলো। সেনারা খুব দ্রুত এই পরিস্থিতি দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনলো।
কিন্তু দাঙ্গা শেষ হলেও সেনাদের কমান্ডিং অফিসার একটি অস্বাভাবিক অনুরোধ জানালেন। তিনি বললেন ব্যারাকে সেনা ফিরিয়ে নেয়ার আগে তার বাহিনীকে কয়েকটা দিন থাকতে দেয়া হোক। এই অল্প কয়েকদিনেই সেনাবাহিনী পুরো শহর পরিষ্কার করে ফেললো। সরকারি অফিসগুলোতে রং লাগানো থেকে শুরু করে, ভাঙ্গা সড়ক সংস্কার করা, অননুমোদিত স্থাপনা উৎখাত, এমনকি সড়কের ধারে গাছও লাগালো সেনাবাহিনী। বহুদিন ধরে নগরজুড়ে এই পৌর কাজগুলো ঝুলে ছিল। সব শেষ করে সেনাবাহিনী নীরবে ব্যারাকে ফিরে গেল। পেছনে রেখে গেল সেনানিবাসের মতো ঝকঝকে তকতকে লাহোর শহর।
এই ঘটনার পরের পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। জনমানুষের কাছে সেনাবাহিনী ব্যাপক বাহবা আর শ্রদ্ধা কুড়ালো। কারণ, সেনারা কয়েকদিনের মধ্যে একটি শহরে এমন সব কাজ করে দিয়ে গেছে, যা বেসামরিক কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ধরেও করতে পারেনি। এ কারণেই ১৯৫৮ সালে যখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটাতে সামরিক আইন (মার্শাল ল’) জারি করে সেনা তলব করলেন, তখন জনগণের একটি বড় অংশ খুশি হলো। এমনকি, মার্শাল ল’র সঙ্গে মিলিয়ে অনেকে তখন মজা করে বলতো, ‘পাকিস্তান মে আব তোহ মাশাল্লাহ হো গায়া’। পরের কয়েক বছর জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে জাতীয়ভাবে অনেক উন্নয়ন হয়েছে পাকিস্তানে। কিন্তু এরপরই সামরিক সরকার নিজের এই প্রকাণ্ড ক্ষমতার কারণে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই ধরনের সিস্টেমে এই পরিণতি অলঙ্ঘনীয়।
পাকিস্তানের মতো ভারতের সেনাবাহিনীও একই ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। বৃটিশ ভারতে সেনাবাহিনী ছিল বেশ প্রভাবশালী। এমনকি নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও ভূমিকা ছিল তাদের। সেনাপ্রধান ছিলেন কার্যত প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ভাইসরয়ের পর তিনিই ছিলেন সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী নেহরু বিশ্বাস করতেন নতুন ভারতে সেনাদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। তিনি এমন একটি নীতি শুরু করলেন যার দরুন সেনাবাহিনীকে স্থায়ীভাবে বেসামরিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের অধীনস্থ করা হলো। স্বাধীনতার পর প্রথম যেসব পরিবর্তন ঘটলো, তার একটি ছিল ‘তিন মূর্তি ভবন’কে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে ঠিক করা। এর আগে ঐতিহ্যগতভাবেই এটি ছিল সেনাপ্রধানের বাসভবন। খুব ছোট একটি পরিবর্তন। কিন্তু হাওয়া কোনদিকে তখন বইছিল, তারই একটি স্পষ্ট নির্দেশক ছিল এটি। এরপরই নেয়া হলো বাজেট কাটছাঁটের পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে বৃটিশ আমল থেকে সেনা কর্মকর্তাদের পাওয়া বিশাল বেতন ভর্তুকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা হলো। ভারতের প্রথম সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল কারিয়াপ্পা যখন প্রকাশ্যে সরকারের অর্থনৈতিক পারফরম্যান্সের সমালোচনা করলেন, তাকে সঙ্গে সঙ্গে তলব করে তিরস্কার করা হলো। বলে দেওয়া হলো তার অধীনস্থ বিষয়-আশয় ছাড়া অন্য কিছুতে নাক না গলাতে।
পরের কয়েক বছর এমন সব পদক্ষেপ নেয়া হলো, যার ফলে সশস্ত্রবাহিনী ও ভারতীয় সমাজে তাদের প্রভাব বেশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লো। ১৯৫৮ সালে প্রতিবেশী পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান দেখতে পেয়ে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসব পদক্ষেপের ওপর অগ্রাধিকার দিলেন। তখন আবার কয়েকদিন আগেই সেনাপ্রধান হিসেবে অবসর নেয়া ফিল্ড মার্শাল কারিয়াপ্পা পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থানের প্রশংসা করেছিলেন। এ নিয়েও উদ্বেগে ছিলেন রাজনীতিকরা। সেনাবাহিনীর মুখে লাগাম পরানোর এই পুরো প্রকল্পের অংশ হিসেবেই কৃষ্ণ মেননকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কৃষ্ণ মেনন ছিলেন একজন ক্ষমতাধর, কর্কশ ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবী। স্পষ্টতই এই নিয়োগ ছিল সেনাবাহিনীকে হেয় করার চেষ্টা। তবে, এর একটি অনিচ্ছাকৃত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল ১৯৬২ সালে চীনের কাছে ভারতীয় বাহিনীর লজ্জাজনক পরাজয়। সেটি আরেক গল্প।
সত্তর দশকের মধ্যেই ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সে’র এক বিস্তৃত কাঠামোর মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অবশেষে ‘অভ্যুত্থান-রোধী’ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা গেল। একে নেহরু আমলের অন্যতম বড় অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমেই ভারতীয় গণতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করে যান নেহরু। এটি এমন এক অর্জন যেটিকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এই অর্জনের গুরুত্ব টের পাওয়া যায় ভারতের প্রতিবেশীদের দিকে তাকালে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, বার্মা, শ্রীলংকা-সব দেশকেই সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে।
স্টিভেন উইলকিনসন তার অসাধারণ বইটিতে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে যথেষ্ট চিন্তাভাবনার মাধ্যমে প্রণীত একাধিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ‘ক্যু প্রতিরোধক’ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়। সামরিক বাহিনীতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনা হয়। গড়ে তোলা হয় শ্রমসাধ্য কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল কাঠামো। পরিবর্তন আনা হয় বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের ‘অর্ডার অব প্রিসিডেন্স’ বা পূর্ববর্তিতার ক্রমে। সেনাবাহিনীতে পদোন্নতির দিকে ঘনিষ্ঠ নজর রাখা হয়। সেনা কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে মন্তব্য করাকে আস্কারা দেয়া হয়নি। পাল্টা ভারসাম্য আনতে প্রতিষ্ঠা করা হয় আধা-সামরিক বাহিনী। এ ছাড়া ছিল আরো ছোট ছোট বিষয়ও। যেমন, নিশ্চিত করা হয়েছে যাতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধানদের দেশে না রেখে দূরবর্তী কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেরণ করা হয়।
এই পুরো প্রক্রিয়ার ফল পাওয়া গেল ২০১২ সালে। সেনাপ্রধান জেনারেল ভি. কে. সিং-এর অবসর-কাণ্ডের প্রাক্কালে পত্রিকাগুলোতে শ্বাসরুদ্ধকর রিপোর্ট প্রকাশিত হলো যে, সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালানো হয়েছে। কয়েকটি সেনা ইউনিটকে কাউকে না জানিয়ে দিল্লি অভিমুখে রওনা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তখন আমার মতো অনেক ভারতীয়ই বিরক্ত হয়ে বলে উঠেছিলাম, ‘হোয়্যাট ননসেন্স!’ আর নিমগ্ন থাকি পত্রিকার খেলার পাতায়। আমরা হয়তো বুঝতেও পারছি না, এই ধরনের নিরুদ্বেগ বা নির্ভাবনাময় পরিবেশ কতটা বিলাসবহুল।
(ভারতীয় কলামিস্ট আনভার আখিলানের এই লেখাটি ছাপা হয়েছে স্ক্রল.ইন ও কোয়ার্টয-এ। অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn