ইমানুজ্জামান মহীঃঃ স্থানীয় ও অস্থানীয় নিয়ে কথা বলে সুনামগঞ্জ পৌর সভার মেয়র আয়ূব বখত জগলুল সুনামগঞ্জবাসীদের অপমান করেছেন। অস্থানীয়দেরে ভাড়াটিয়া উল্লেখ করে তিনি অস্থানীয়দের প্রতি বিদ্ধেষ ও ঘৃণা প্রকাশ করায় সুনামগঞ্জবাসীর কাছে তার প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবী জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান। আঞ্চলিতায় দোষে দুষ্ট তার এ বক্তব্য প্রত্যাহার না হলে দলীয় ভাবে মেয়র জগলুলকে বর্জনের কথাও তিনি বলেন।

সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আয়ূব বখত জগলুল-এর আহ্বানে গত ২৭ ডিসেম্বর হলো সুনামগঞ্জ শহরে বিজয় র‍্যালি। বিজয় দিবসের দশ দিন পর অনুষ্টিত এই ‘বিজয় র‍্যালি’ মূলত ছিল তার পক্ষে শোডাউন। উদ্দেশ্য হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের প্রার্থীতার কথা জানান দেয়া। র‍্যালি শেষে সভায় তিনি তাই ঘোষনা করেন আর তাতেই প্রমানিত হয় তার আসল উদ্দেশ্য। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে এই র‍্যালির কথা প্রচারিত হলেও একটি বারের জন্য ১৯৭১ এর স্বাধীনতা। নয় মাসের রক্তক্ষয়ি মুক্তিযুদ্ধ। লক্ষ শহীদের আত্মদান। রীরঙ্গনা মা বোনের ইজ্জদ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথা কাহিনী কিছু আসেনি তার বক্তব্যে। তিনি বলেননি মানবতা বিরোধী স্বাধীনতার শত্রু জাতামাত শিবিরের কথা। তবে তার ভাষনে উঠে এসেছে দলের সমালোচনা। সেই সাথে জেলার দায়িত্ব  প্রাপ্ত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার আর বিদ্ধেষের কথা ।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় কমিটির সদস্য-এর নাম ভাঙ্গিয়ে এবং আওয়ামী লীগের ব্যানারে তিনি র‍্যালির আয়োজন করলেও দলের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলেননি। কথা বলেননি জেলার শীর্ষস্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে। উপরন্তো একই দিনে আয়োজিত আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন  জেলা কৃষক লীগের বর্ধিত সভাকে বানচাল করার জন্য তিনি এই পাল্টা কর্মসূচী ঘোষণা দেন। জেলা  কৃষক লীগের এই বর্ধিত সভায় জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি, সাধারন সম্পাদক, সাবেক সাধারন সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সহ জেলার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকলেও দলের কেন্দ্রীয় নেতা হয়েও তিনি কোন সহযোগিতা করেননি।

বিজয় র‍্যালি পরবর্তী সভায় পৌর মেয়র আঞ্চলীকতার প্রসংগ টেনে এনে বলেন,আগামীতে ভাড়াটিয়াদের নয়, স্থানীয় সন্তানকে সুনামগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন দিতে হবে। তিনি নিজেকে স্থানীয় প্রার্থী এবং আগামী সংসদে সুনামগঞ্জ ৪ আসনের আওয়ামীলীগের প্রার্থী ঘোষণা করে বলেন, বিগত দিনে সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসনের যারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের কেউই সুনামগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন না। এই অস্থানীয়রা নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও সুনামগঞ্জের যে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সাধন হওয়ার কথা ছিল তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান ও সাধারন সম্পাদক ব্যারিষ্টার এম,এনামূল কবীর ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলেন,আজকে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন যে দুইজন মানুষ তাদের একজন থাকেন ঢাকার মহাখালীতে, আরেকজন থাকেন ধানমন্ডিতে। তাহলে কিভাবে এ অঞ্চলের উন্নয়ন হবে?

তিনি ইঙ্গিত করে আরো বলেন, ‘মানুষ কোথায় আর আপনারা কোথায়? যে সাধারণ মানুষ পুরো বাংলাদেশকে তাদের শ্রম দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে, যাদের ভোটেই সরকার নির্বাচিত হয়। সে সাধারণ মানুষকে বাদ দিয়ে দুই-তিনজনকে নিয়ে ফন্দি করা, দুর্নীতি করা, রাতারাতি কোটি টাকার গাড়ি আর বাড়ি বানানো নিয়ে দৌড়ঝাঁপ, জনগণ এই চোরদের ছাড়বে না। উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা যদি সুনামগঞ্জের উন্নয়ন চান তাহলে সুনামগঞ্জের সন্তানকেই নির্বাচিত করতে হবে।

দলীয় নেতা হয়ে দলীয় নেতাদের প্রতি মেয়র জগলুলের এই দৃষ্টি ভঙ্গির ব্যাপারে জানতে চেয়ে ‘সুনামগঞ্জবার্তা’ অনলাইনের পক্ষ থেকে জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান ও সাধারন সম্পাদক ব্যারিষ্টার এম এনামূল কবীর ইমনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হয়।

দীর্ঘ আলোচনায় সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, মেয়র জগলুল যতোনা আওয়ামীলী তার চেয়ে বেশী সে আওয়ামীলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে ফায়দা লুটছে। বিগত মেয়র নির্বাচনে নৌকার প্রতিকে নির্বাচন করায় প্রথমবারের মতো নৌকায় ভোট দেয়। ভোটার হওয়ার পর প্রথমবারের মতো নৌকায় ভোট দিয়ে সে নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙ্গে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আমরা সবাই তা জানি।  তার নির্বাচনী পোষ্টার, ব্যানারে তারপরও নৌকা ছাড়া জননেত্রী শেখ হাসিনা,বঙ্গবন্ধুর ছবি এমনকি জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান ও নিষিদ্ধ ছিল। কেন নিষিদ্ধ ছিল তাও সবাই জানেন। জামাত শিবির এবং তার নিকট আত্মীয় কেন্দ্রীয় জামাত নেতাকে খুশী করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা আওয়ামীলীগ এখানে বড় নয়।

মতিউর রহমান বলেন, উন্নয়ের ব্যর্থতার কথা বলে সে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের সাফল্যকে ম্লান করে দিতে চায়। সুনামগঞ্জে আওয়ামী সরকারের বিগত ৯ বছরের শাসন আমলে যে উন্নয়ন হয়েছে বিগত ৩৪ বছরেও তা হয়নি। শুধু সুনামগঞ্জ নয় সারা বাংলাদেশে আজ উন্নয়নের জোয়ার বইছে। সুনামগঞ্জ ৪ আসনে দলীয় সাংসদ না থাকায় হয়তো ঠিক মতো এখানে তা তদারকি হচ্ছে না। আগামীতে আমরা তাই নেত্রীকে অনুরোধ জানাবো জোটবদ্ধ নির্বাচন হলেও যেন জেলা সদর আসনটি দলের জন্য সংরক্ষিত থাকে। মেয়রের স্থানীয়-অস্থানীয় নিয়ে বক্তব্য দেয়ার ব্যাপারে মতিউর রহমান প্রশ্ন করেন, তিনি যে পৌর সভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন শুধু কি স্থানীয়দের ভোটে ? না অস্থানীয়দের ভোটের প্রয়োজন  ছিল?

তিনি বলেন, নির্বাচনে আঞ্চলিতা প্রসঙ্গ এনে মূলতঃ মেয়র জগলুল স্থানীয়-অস্থানীয়দের মাঝে দ্বন্ধ সৃষ্টি করতে চান। তার উদ্দেশ্য যে ভালো নয় সভায় উপস্থিত অনেকেই তা বুঝতে পেরেছেন। অস্থানীয়দের ভাড়াটিয়া বলে তিনি আসলে ভোটারদেরকে অপমানিত করেছেন। তার উচিত হবে অচিরেই সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এই ভুলের জন্য জনগনের কাছে ক্ষমা চাওয়া। মতিউর রহমান আরো উল্লেখ করে বলেন, মেয়র কি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ভাড়াটিয়া বলবেন? দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা নিজেওতো তার নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকা থেকে প্রার্থী হন। ঢাকার বেশীর ভাগ আসন এমনকি গুনলে সারা বাংলাদেশে শতশতো আসনে অস্থানীয়রা নির্বাচন করছেন তার উদাহর দেয়া যাবে। সুনামগঞ্জ ৪ আসনে অতীতে যারাই নির্বাচন করেছেন তাদের প্রায় সকলের জন্ম, বাসস্থান সুনামগঞ্জে তারপর তারা কি ভাবে ভাড়াটিয়া হন?  এ প্রশ্ন আমার। তিনি বলেন, নির্বাচিত জন প্রতিনিধি হয়ে মেয়র অস্থানীয়কে নিয়ে যে কটুক্তি করেছেন বৃটেন আমেরীকা হলে আজ তার বিরোদ্ধে মামলা হতো। নিজ পদে থাকার নৈতিকতা তিনি হারাতেন।

 জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মতিউর রহমান মেয়র জগলুলের কর্মকান্ডের সমালোচনা করে বলেন, নির্বাচনের আগে দলীয় নেত্রীর নির্দেশে যেখানে আমরা সবাই মিলে জেলা আওয়ামীলীগকে ঐক্যবদ্ধ করে আগামী নির্বাচনে সুনামগঞ্জ জেলার ৫টি আসনে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করতে চাই। সেখানে মেয়র জগলুল আমাদের মধ্যে বিবেদ সৃষ্টির করার তৎপরতায় লিপ্ত। বিবেদ এবং গ্রুপিং এর জন্য অতীতে সে দল থেকে বহিস্কৃত হয়েছিল। গ্রুপিং করা তার স্বভাবগত দোষ। তার কারনে অতীতে অনেক ভালো ছেলেরা ছাত্রলীগ করতে পারেনি। অনেকে যুবলিগ এমনকি আওয়ামীলীগ করতে পারেনি। বর্ষীয়ান নেতা মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ তার দ্বারা অপমানিত হয়েছেন। দলের বিপক্ষে কাজ করায় এক সময় সে দল থেকে বহিস্কার হয়। পরবর্তীতে সদস্য পদ ফিরিয়ে দেওয়া হলেও তাকে কোন দায়িত্ব দেয়া হয়নি।

তিনি বলেন, সে ঢালাও ভাবে কোন তথ্য প্রমান ছাড়া জেলার সকল নেতৃবৃন্ধকে দূর্ণীতিবাজ, চোর বাটপাট বলে মূলতঃ বিরোধীদলের কর্মীর ভূমিকায় অবর্তীন হয়েছে। তথাকথিত তার ‘বিজয় র‍্যালি-এর পরবর্তী সভায় তার ভাষন পর্যালোচনা করলে তাই দেখা যায়। আওয়ামীলীগের প্রতিদ্বন্ধি বিএনপি জামাত শিবিরের অতীত কর্মকান্ড নিয়ে তার নিরবতা তাই প্রমান করে। বিজয় র‍্যালির নামে সে নিজ দলের হাড়ি হাটে ভাংতে মাঠে নেমেছেন তার ভাষনে তাই প্রমানিত হয়।

আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ব্যারিষ্টার ইমন-এর ভাষাও ছিল সভাপতি মতিউর রমানের মতোই। ইমন বলেন, মেয়র জগলুল আওয়ামীলীদের উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি কি সাধারন মানুষ যা দেখে তা দেখেন না? বাচ্চারাও আজ বলেতে পারে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে কি পেয়েছে আর অন্য সরকারের আমলে কি পায়নি। তিনি কি মরহুম আব্দুজ জহুর সেতু দেখেন না? গ্রামেগঞ্জের রাস্তাঘাট,কাল্ভাট দেখেন না? হাওর উন্নয়নের সরকারের কোটিকোটি টাকা বরাদ্দ, স্লুইসগেইট, ক্লোজার, দেশের বৃহত্তর মিছাখালী রাবার ডাম, নির্মিতব্য ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সাব ষ্টেশন দেখেন না ? তিনি কি  শুনেননি প্রস্তাবিত মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইন্সটিটিউটের কথা ? এ সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্থি বলতে গেলে তালিকা আরো বড় হবে।

ব্যারিষ্টার ইমন বলেন, অন্যের দোষ খোঁজার আগে নিজের দোষ খূঁজোন। পৌরসভার মেয়র হিসাবে আপনার দোষ গুণের আমলনামাও আমাদের হাতে আছে। সময় আসলে তা এমনিতেই বেড়িয়ে আসবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn