সারা জীবন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। শেষ বিদায়েও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সহস্র মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত হলেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, এফডিসি সর্বত্র হাজার হাজার মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানান। সবার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সঙ্গে নিয়েই আজ বুধবার চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন তিনি। ভোরে তার মেজো ছেলে রওশন হোসেন বাপ্পি দেশে ফেরার পর সকাল ১০টায় বনানী কবরস্থানে দাফনের কথা। সে অবধি রাজ্জাকের মরদেহ রাখা হবে ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে।
মঙ্গলবার সকালে হিমঘর থেকে নায়করাজকে নেয়া হয় তার বাসভবনে। সেখান থেকে প্রিয় কর্মস্থল এফডিসিতে। দুপুরে নেয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। প্রতিটি স্থানে সর্বস্তরের মানুষ নায়করাজকে শ্রদ্ধা জানান। এফডিসি ও গুলশান আজাদ মসজিদে রাজ্জাকের দুই দফা জানাজা সম্পন্ন হয়। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল, মুকুটহীন সম্রাট নায়করাজ রাজ্জাক। সেখান থেকে মঙ্গলবার সকালে তার মরদেহ শেষবারের মতো নিয়ে যাওয়া হয় গুলশানের বাসভবন ‘লক্ষ্মীকুঞ্জ’-তে। মরদেহ সেখানে পৌঁছতেই স্বজনদের কান্না-আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে আশপাশ। সেখান থেকে বেলা ১১টায় মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার প্রিয় কর্মস্থল এফডিসিতে। শেষবারের মতো নায়করাজের এফডিসিতে আগমনে শোকার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আগত শিল্পী-কলা-কুশলীরা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে ওঠেন।

এফডিসিতে লাশবাহী গাড়ি খোলা রেখেই শেষবারের মতো সবাই দেখেন নায়করাজকে। এরপর একে একে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র পরিবার, সিনেম্যাক্স মুভি পরিবার, আওয়ামী সাংস্কৃতিক লীগ, বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাব, চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থা, চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি, সিনে স্থিরচিত্রগ্রাহক সমিতি, জাসাসসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ব্যক্তিগতভাবে রাজ্জাককে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, অভিনেতা আলমগীর, চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী, সুচন্দা, ববিতা, চম্পা, শাবনূর, চিত্রনায়ক শাকিব খান, ফেরদৌস, আমিন খান, রুবেল, আহমেদ শরীফ, ওমর সানি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি অভিনেতা মিশা সওদাগর, চলচ্চিত্র পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ, চলচ্চিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম প্রমুখ। শ্রদ্ধা জানানোর পর সেখানেই তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

উপস্থিত সবার উদ্দেশে রাজ্জাকের বড় ছেলে অভিনেতা বাপ্পারাজ বলেন, ‘আমার আব্বা সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। তিনি জীবনের পুরোটা সময় আপনাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, এর মধ্যে যদি কারও সঙ্গে কোনো লেনদেন থেকে থাকে, তাহলে আমার বা আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’এফডিসিতে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘এ দেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য আমৃত্যু নায়করাজ রাজ্জাক ভেবেছেন। আমরা সরকারিভাবে তার এই কর্মকাণ্ডকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব। যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তার কর্মময় জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারে।’

এফডিসিতে শেষবারের মতো রাজ্জাককে দেখতে এসেছিলেন তার প্রথম নায়িকা সুচন্দা। তিনি বলেন, ‘রাজ্জাক নায়কের মতো রুপালি পর্দায় এসেছিলেন। তার চলে যাওয়াটাও নায়কের মতোই। তিনি কখনও কারও কাছে ছোট হননি। বাস্তব জীবনেও তিনি মহানায়ক ছিলেন।’ ববিতা বলেন, ‘আমার জীবনের ব্যবসাসফল ও ভালো ছবি রাজ্জাকের সঙ্গে। রাজ্জাকের পর্দা উপস্থিতি ছিল ভিন্ন রকমের। এখনকার নায়করাও তাকে অনুসরণ করে।’ আলমগীর বলেন, ‘আসলে আমার বলার কিছুই নেই। একজন সন্তান পিতাকে হারালে যেমন কষ্ট পায়, আমি তেমনিই কষ্ট পাচ্ছি।’ গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘রাজ্জাক ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল- এ দেশের চলচ্চিত্র বিশ্ব দরবারে স্থান করে নেবে। এটা হলেই তার স্বপ্ন সার্থক হবে, আত্মা শান্তি পাবে।’ চম্পা বলেন, ‘আমি উনার সঙ্গে খুব কম ছবিতেই কাজ করেছি। তবে তার মতো অভিভাবক আমরা আর পাব কিনা জানি না।’ শাবনূর বলেন, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না, রাজ্জাক আঙ্কেল আর নেই। পর্দার নায়করাজের চেয়ে, পর্দার পেছনের রাজ্জাক আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’ শাকিব খান বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম এবং আগামী যত প্রজন্ম আসবে তাদের কাছে নায়করাজ প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। আমরা আমাদের একজন আইডল হারালাম।’ ওমর সানী বলেন, ‘তাকে আমরা অবেলায় হারালাম। তার আরও অনেক কিছু দেয়ার ছিল। তবে নিজের কর্মের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে আজীবন বেঁচে থাকবেন।’ রুবেল বলেন, ‘রাজ্জাক ভাই এমন একজন মানুষ ছিলেন, যার অভাব পূরণ হওয়ার নয়। বছরখানেক আগে আমাদের দেখা হয়েছিল, কুশলবিনিময় হয়েছিল। এ ছাড়া তেমন কোনো কথা হয়নি। বেশকিছু ছবিতে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করা হয়েছে।’

এফডিসি থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় রাজ্জাকের মরদেহ। তার অনেক আগেই সেখানে আসতে শুরু করেন রাজ্জাকের ভক্ত-অনুরাগীরা। হাজার হাজার মানুষ ফুল হাতে অপেক্ষা করতে থাকেন তাদের প্রিয় অভিনেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় এ নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের যে ঢল নামে তা ছিল দেখার মতো। আয়োজনের পুরোটা সময় রাজ্জাকের মরদেহের পাশে ছিলেন দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট, চিত্রনায়ক জাভেদ ও শাকিব খান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ।

শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। বিএনপির পক্ষে শ্রদ্ধা জানায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানসহ আরও অনেকে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রাজ্জাককে শ্রদ্ধা জানায় বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, অভিনয় শিল্পী সংঘ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, এনটিভি, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, ঋষিজ, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়ার্কার্স পার্টি, দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদ, মুক্তধারা সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, বাউল একাডেমি ফাউন্ডেশন, যুব সমিতি, সুবচন নাট্য সংসদ, দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট, ডিরেক্টরস গিল্ড, দেশ টিভি, প্রজন্ম ৭১, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি ইত্যাদি।

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দীর্ঘ পাঁচ দশক তিনি আমাদের চলচ্চিত্রে অবদান রেখেছেন। তার চলে যাওয়ার ক্ষতি অপূরণীয়। রাজ্জাক ছিলেন এ বাংলার উত্তম কুমার।’ সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘বাংলা ছবির নির্মাণের ইতিহাস দেখলে বলতে হয়, যে ব্যক্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলা চলচ্চিত্র দাঁড়িয়েছিল তিনি রাজ্জাক। নিজের দক্ষতা, নিজের গুণে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি আমাদের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। আজ বাংলা চলচ্চিত্রের প্রধান স্থপতি চলে গেলেন।’ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘রাজ্জাকের বিনয়ের প্রেমে পড়েনি, এমন মানুষ বোধহয় নেই। এত জনপ্রিয় মানুষ হয়েও সে তার অতীতকে ভোলেনি। সিনিয়রদের সম্মান করা ছিল তার স্বভাবগত ব্যাপার। সে সব শ্রেণীর মানুষকে শ্রদ্ধা করত।’ রোজিনা বলেন, ‘আমার জীবনের প্রথম ছবি ‘আয়না’-তে নায়ক হিসেবে তাকে পেয়েছিলাম। তার সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে আমার হাত-পা কাঁপছিল। সেটা বুঝে তিনি আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। অভিনয়ের অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন।’

জয়া আহসান বলেন, ‘উনার বাচনভঙ্গি থেকে শুরু করে সবকিছু দারুণ মার্জিত। এরকম পারফেক্ট একটা মানুষকে হিরো হিসেবে দেখি না এখনও। যাওয়ার সময় হলে তো সবাই যায়, কিন্তু আমাদের এখানে তো একটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেলে পূরণ হতে অনেক সময় লাগে। তার চলে যাওয়ায় এ জায়গাটা আর কখনও হয়তো পূরণ হবে না।’নায়করাজের দাফন আজ : বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে মেজো ছেলে রওশন হোসেন বাপ্পি ইতিমধ্যে ঢাকার উদ্দেশে বিমানে রওনা দিয়েছেন। কানাডা থেকে তিনি ঢাকায় পৌঁছবেন আজ ভোরে। ছেলেকে শেষবারের মতো না দেখিয়ে বাবাকে দাফন করতে চায়নি পরিবার জানিয়ে চিত্রনায়ক আলমগীর বলেন, সকাল ১০টায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে নায়করাজকে।

নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রীর শোক : দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শোকবার্তায় মন্ত্রী বলেন, শক্তিশালী অভিনেতা, পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অন্যান্য পুরস্কারে ভূষিত নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে দেশ একজন নিবেদিতপ্রাণ অভিনেতাকে হারাল। তিনি বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও তার মেধা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার মৃত্যু দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তিনি মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn