মানুষ চেনা বড় দায়
সামিয়া রহমান:
একদা এক রাজ্যে এক বৃদ্ধা বসবাস করতেন। সে যুগেও ছিল ইন্টারনেট, ছিল অজস্র অনলাইন পোর্টাল। সে বুড়ির ছিল না কোনো সন্তান। কিন্তু ছিল চারটি সেয়ানা ভাগ্নে। বুড়ি ভাবলেন এরা যদি বুদ্ধিমান না হয় তবে এদের অর্থ সম্পদ দিয়ে লাভ কী! তার চেয়ে বরং সবচেয়ে যে বুদ্ধিমান তাকেই তিনি উত্তরাধিকারী বানাবেন। মহিলা তার চার ভাগ্নেকে ডাকলেন এবং প্রত্যেককে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, আমি বেশি কিছু চাই না। এক বছর পর এই পঞ্চাশ হাজার টাকা আমাকে ফেরত দিতে হবে। আর যে ফেরত দেবে সে-ই হবে আমার উত্তরাধিকারী। পার হলো এক বছর। চার ভাগ্নে ফিরে এলো। প্রথমজন গভীর দুঃখের সঙ্গে বলল, খালা আমি ব্যাংকের লকারে টাকা বহু সাবধানে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
কিন্তু ডাকাত এসে ব্যাংক ডাকাতি করে সব নিয়ে গেছে। এবার পালা দ্বিতীয়জনের। সে বলল, খালা বিশ্বাস করেন আমি টাকাটা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে একজনকে দিয়েছিলাম। সে বেইমানি করেছে আমার সঙ্গে।
বৃদ্ধা তৃতীয়জনের দিকে তাকালেন। সে মাথা নিচু করে বলল, নিরাপদে রাখার জন্য বাসার মেঝেতে গর্ত খুঁড়ে টাকাটা রেখেছিলাম। খেয়াল করিনি, বন্যায় সব ভেসে গেছে।
এবার পালা চতুর্থজনের। সে বৃদ্ধার হাতে এক লাখ টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে বলে, এই নিন আপনার পঞ্চাশ হাজারের সঙ্গে আরও পঞ্চাশ অর্থাৎ মোট এক লাখ টাকা। খালা মহাবিস্মিত। কীভাবে সম্ভব?
ভাগ্নে এক গাল হেসে বলে, মানুষই মানুষের শত্রু। তাই মানুষকে বিশ্বাস করার চেয়ে চিন্তা করলাম অর্থ যদি মানুষের ধ্বংসে লাগাই তবেই তো বাজিমাত। একজনের সঙ্গে বাজি ধরেছিলাম। শর্ত ছিল টেনে হিঁচড়ে একজনকে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু পুলিশের কাছে ধরা পড়া যাবে না। ভাবলাম কুৎসা যদি রটানো যায় তবে কি আর শারীরিক ক্ষতি লাগে? পুলিশও থাকে তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদি একটা ঘটনার বীজ থেকে ডালপালাসহ ঘটনার বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দিতে পারি, তবে সে আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে। তো ঘটনার ডালপালা কী, আমি তো নাতিপুতিও জন্ম দিয়ে ফেলেছি।
মানুষ চেনা বড় দায়। মানুষ এমনই এক প্রাণী—যে গাছ কাটে, কাগজ বানায়, আবার সে কাগজেই বড় করে লেখে—গাছ বাঁচাও। নিজেরে কাটিয়া আমি নিজেরেই প্রমাণ করি আমারে কাটিও না।
মানব প্রজাতির এক সন্তান একবার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মানব মস্তিষ্ক যদি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাজ করে, তবে পরীক্ষার হলে ঢুকলে মস্তিষ্কের কাজ বন্ধ হয়ে যায় কেন? ঠাট্টা নয়, আচ্ছা প্রশ্ন করি আপনাদের, মস্তিষ্ক যদি কাজই করে, তবে সে মস্তিষ্ক অন্যায় করে কেমন করে? বেঁচে থেকেও কেন নানা দূরভিসন্ধি, নোংরামি বাসা বাঁধে মননে-মগজে?
মানব মস্তিষ্ক কী অদ্ভুত অরগ্যান। হিংসা, ঘৃণা, দ্বেষ, ভালোবাসা সবই হরমোনাল অ্যাকশন। একটা গল্প বলি। এক ব্যক্তি কিছুতেই কারও ভালো দেখতে পারে না। সব সময় সবার দোষ খুঁজে বেড়ায়। সে গ্রামে বাস করত এক মহিলা। তার রান্নার সুখ্যাতি ছিল দেশজুড়ে। সবাই ভাবল ওই ব্যক্তিকে যদি মহিলার রান্না খাওয়ানো যায় তবে নিশ্চয়ই তার অভিযোগের পাহাড় কিছুটা হলেও কমবে। তো কথামতো ওই মহিলা সুস্বাদু তরকারি রান্না করে নিয়ে এলো। ভদ্রলোক খেলোও বটে। সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে উত্তরের জন্য। ভদ্রলোকের উত্তর, রান্না হয়েছে কোনোরকম, কিন্তু যেটুকু আরও জঘন্য হয়েছে সেগুলো কী শেয়াল কুকুরকে দেওয়া হয়েছে?
আরেকটি ঘটনা বলি। স্বামীর দ্বারা প্রতারিত হয়ে এক মহিলা মনের দুঃখে মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার মহাব্যস্ত। বহু সাধ্য-সাধনা করে মহিলা ডাক্তারের অ্যাপয়নমেন্ট পেলেন। ডাক্তারকে বললেন, দেখুন ডাক্তার সাহেব আমি আমার সারা জীবন স্বামীর সঙ্গে ছিলাম। তাকে সাহায্য করেছি, সেবা-যত্ন করেছি। কিন্তু কী পেলাম! সে একটি অল্প বয়স্ক মেয়ের সঙ্গে চলে গেল আমাকে ফেলে। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। আমি এখন কী করব?
ডাক্তার তাকে একটি মিষ্টি খেতে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, মিষ্টিটা খেতে কেমন? মহিলা হেসে বললেন খুবই মজা।
ডাক্তার বললেন, আর একটি খেতে ইচ্ছা করছে?
হুমম, অবশ্যই, মহিলা বললেন।
ডাক্তার : এবার বুঝতে পারছেন আপনার সমস্যাটি কী?
মহিলাটি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, হুমম আমি বুঝতে পারছি মানুষ আসলে লোভী শ্রেণির প্রাণী। সে একটা পাবে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটার জন্য লালায়িত হবে। হয়তো সেটি হবে নতুন বা আরও ভালো কিছু। কোনো কিছুতেই মানুষের সন্তুষ্টি নেই। আমরা আসলে সচেতন থাকব কিন্তু এ নিয়ে মন খারাপের কিছু নেই।
মানসিক রোগের ডাক্তার বললেন, আরে আমার কথা তো শেষ হয়নি। আমি বলতে চাইছিলাম আপনি যেমন মোটা মানুষ, মিষ্টির প্রতি আপনার আকর্ষণ কমানো উচিত। কম খাওয়া উচিত।
স্বামী বা ডাক্তারটির নিষ্ঠুরতা-চতুরতা বা ঠাট্টা কী এই লোকটির চেয়ে কম? এক দোকানে এক কাস্টমার ভুল করে ফোন রেখে চলে গেল। এখন দোকানদার লোকটাকে জানাবে কীভাবে? সে মোবাইলে সার্চ লিস্টে ‘মা’ নাম দেখে ফোন দিল। ওপর প্রান্ত থেকে উত্তর এলো, ডার্লিং এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
চারদিকে শুধু মিথ্যা, কুৎসা, গীবত। কী শান্তি এতে তাই না! আচ্ছা নিজেকে প্রশ্ন করুন তো জীবনে যত মানুষের সমালোচনা করেছেন তত মানুষের প্রশংসা করেছেন কী?
এই নিয়েছে ওই নিল যা! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
শামসুর রাহমানকে ধন্যবাদ পণ্ডশ্রম করে মনুষ্য চরিত্র আগেই উদ্ভাবন করে ফেলেছিলেন বলে।
শিক্ষক ছাত্রকে প্রশ্ন করল, বল তো পৃথিবীর আকার কী রকম?
ছাত্র : গোলাকার, স্যার।
শিক্ষক : বেশ বেশ! এবার প্রমাণ দাও কী করে বুঝলে যে পৃথিবী গোল।
ছাত্র : জোরালো প্রমাণ আছে, স্যার। প্রথম সাপ্তাহিক পরীক্ষায় পৃথিবী চ্যাপ্টা লিখে শূন্য পেয়েছি।
দ্বিতীয় সাপ্তাহিক পরীক্ষায় চৌকোনা লিখেও শূন্য পেলাম। তারপর লিখলাম পৃথিবী লম্বা, তাও আপনি কেটে দিয়েছেন। শেষে অনেক ভেবে-চিন্তে লিখেছিলাম তিনকোণা, তাও আপনি কেটেই দিলেন। তা হলে আর বাকি রইল কী? গোল হওয়া ছাড়া পৃথিবীর আর তো কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছি না!
উপায় নেই বলেই একজন মানুষের পক্ষে একই সঙ্গে মেধাবী, সুশ্রী, উচ্চপদে আসীন, ক্ষমতাবান, দরিদ্র নয়, সৃজনশীল—এত গুণের অধিকারী হওয়া তো অসম্ভবের অসম্ভব। বেশি পাওয়ার একটা সীমা তো আছে! সবাই তো আর অনন্ত জলিল নয়। তাই চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে। কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে। পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে। যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
দুই লোকের মধ্যে মহা তর্কাতর্কি। শেষ পর্যন্ত তা আদালতে যেয়ে দাঁড়াল। বিচারক ও অভিযুক্ত আসামি…
বিচারক : তুমি কি এই লোকটিকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করেছ?
অভিযুক্ত আসামি : না স্যার এটা মিথ্যে কথা।
বিচারক : তাহলে কী করেছ।
অভিযুক্ত আসামি : আমি শুধু ফেসবুক আর কিছু অনলাইন পোর্টালে তাকে চোর আর নোংরা দেখানোর চেষ্টা করেছি। মহামান্য বিচারক আপনি বলুন— হয়নি খারাপ তাই বলে কি খারাপ হবে নাকো? নৈতিকতার ঝাণ্ডা মোরা না যদি তুলি তবে, এই জাতি কবে নৈতিক হবে?
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, পরনিন্দা যদি সমাজের কণায় কণায় মিশিয়া না থাকিত তবে নিশ্চয়ই একটা বড় রকমের অনর্থ ঘটিত। উহা লবণের মতো সমস্ত সংসারকে বিকার হইতে রক্ষা করিতেছে। তা ছাড়া সুখও পাইব না অথচ নিন্দা করিব, এমন ভয়ঙ্কর নিন্দুক মনুষ্য জাতিও নহে।
শেষ করছি আরেকটি গল্প দিয়ে। যে কোনো মানুষের জন্য নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানো কঠিন। পৃথিবী তো নিজের ইচ্ছায় চলে না। আর অন্যকেও সেভাবে চালানোও সম্ভব নয়। কিন্তু একবার এক প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা তার দুজন কর্মীকে দিয়ে এই পরীক্ষাটি চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের বিষণ্ন এক তরুণ কর্মীকে ডাকলেন। দৃঢ়ভাবে বললেন, আমি চাই না আমার প্রতিষ্ঠানের কেউ মন খারাপ করে কাজ করুক। এরপর যদি আমি এরকম দেখি তবে ছাঁটাই করতে বাধ্য হব। এরপর তিনি ডাকলেন চটপটে তরুণ কর্মীকে। বললেন, তুমি কোনো কিছু সিরিয়াসলি নাও না। সব সময় হাসি-ঠাট্টা তামাশা। তুমি থাকলে কেউ কাজ করতে চায় না। ছেলেটি কিছু বলতে চাইলেও বস তাকে থামিয়ে দেন এবং বলেন এক সপ্তাহ সময় দিলাম তোমাদের নিজেদের শুধরে নেওয়ার। এক সপ্তাহ পর বড়কর্তা দেখেন পরিস্থিতির কোনোই উন্নতি নেই। যে কে সেই। বিষণ্ন বাবা বিষণ্নই রয়ে গেছেন আর হাসি-খুশি ছেলেটি ঠাট্টা-তামাশা করেই যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে তিনি দুজনকেই ডাকলেন। বললেন, তোমরা কেউ শোধরাওনি। তাই এখন থেকে তোমরা পাশাপাশি বসবে আর নিজেদের যে সমস্যাগুলো আছে তা শুধরে নেবে। কিন্তু বিধি বাম। শেষে বড়কর্তা বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন তোমরা নিজেদের ঠিক করতে পারছ না?
চটপটে ছেলেটির চটপট উত্তর, ওকে স্যার। আমি পারিনি। কারণ ও সব কিছু নিয়ে এত টেনশন করে, বিষণ্ন থাকে। অথচ সে বিয়ে করেনি, বউ-বাচ্চা নেই, তার প্রয়োজনের চেয়ে বেতন বেশি। কিন্তু সে এ বিষয়ে আনন্দ পাওয়ার চেয়ে দুঃখেই থাকে বেশি। ওই আমার কাছে একটা জোক মনে হয়। তাই স্যার আমি শুধু হাসতেই থাকি।
এবার বিষণ্ন তরুণের উত্তর, স্যার ওর কি কোনো আইডিয়া আছে ওর ঘাড়ে কী পরিমাণ বোঝা? ওর বউ আছে, তিনটা বাচ্চা আছে। বেতন আমার সমান। কীভাবে সে এত কিছু ম্যানেজ করবে? এই টেনশনেই তো আমি আরও বিষণ্ন থাকি।
এ যুদ্ধ নিজের সঙ্গে নিজের। এ যুদ্ধ ভালোবাসা আর ঘৃণার যুদ্ধ। নিজের চরকার চেয়ে পরের চরকা আমাদের অনেক প্রিয়। নিজের ভুলের চেয়ে পরের ভ্রান্তি অনেক আনন্দের। সে ভ্রান্তি শুদ্ধ না অশুদ্ধ তা যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন এক ফোঁটা হেমলক ঢেলে দেওয়া। তাই তো কবির ভাষায় বলি,
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
সবাই মোরে ছাড়তে পারে, বন্ধু যারা আছে,
নিন্দুক সে ছায়ার মতো থাকবে পাছে পাছে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।