‘মিলে ধানও নাই, চালও নাই, লাইসেন্স নবায়ন কইরা কিতা অইবো’
হিমাদ্রি শেখর ভদ্র-
‘হাওরের পানিত ফসলডুবির পর থাকি মিলঘরে তালা দিয়া রাখছি। ছয় মাসে ৬০০ টাকারও ধান ভাঙ্গাইতে পারি নাই। মিলে ধানও নাই, চালও নাই, লাইসেন্স নবায়ন কইরা কিতা অইবো।’ আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে চাল ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নবায়ন করার যে নির্দেশ সরকার দিয়েছে, সেব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের সেমি আটো রাইস মিলের মালিক মহিউদ্দিন মোহর। সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের বেতগঞ্জ বাজারের চায়না হাসকিং রাইস মিলের মালিক নিকুঞ্জ পাল বলেন, ‘অন্যান্য বছর এমন সময় ধান মিলিং করে শেষ করতাম। এইবার অহন পর্যন্ত মিলে একমণ ধান ভাঙ্গানোর লাইগ্গাও কেউ লইয়া আইছে না। ঘরে তালা দিয়া বইয়া রইছি। সারামাস দুয়ার খুইল্লা বইয়া থাকি, একমুঠ ধানও কেউ লইয়া আইছে না।’প্রসঙ্গত, বছরের শুরুতে অকাল বন্যায় সুনামগঞ্জের ৯০ ভাগ জমির কাঁচা বোরো ধান তলিয়ে যায়। ফলে কৃষকের ঘরে একমুঠ ধান-চালও নেই। তাই মিল মালিকরা তাদের ঘরে তালা দিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের খোঁজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলা সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, ছাতক, জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুরসহ ১১টি উপজেলায় সাত জন পাইকারি চাল ব্যবসায়ী, ২১৯ খুচরা চাল ব্যবসায়ী রয়েছেন। দুটি অটোমেটিক, ২৩৭টি সেমি অটোমেটিক ও দুটি হাসকিং মিল রয়েছে। এছাড়া, দুটি ময়দা কল ও দুটি আটা চাক্কি মেশিন রয়েছে। সদর উপজেলায় দুই জন পাইকারি ও খুচরা ৩৬ জন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে পাইকারি একজন খুচরা, ব্যবসায়ী ১০ জন, ছাতকে খুচরা ব্যবসায়ী ৯ জন, জগন্নাথপুরে সাত জন, দিরাইয়ে পাইকারী ব্যবসায়ী দুই জন ও খুচরা ব্যবসায়ী ২৭ জন, শাল্লায় পাইকারী ব্যবসায়ী দুই জন ও খুচরা ব্যবসায়ী ২২ জন, ধর্মপাশায় খুচরা ব্যবসায়ী ৬০ জন, জামালগঞ্জে ২০ জন খুচরা ব্যবসায়ী, তাহিরপুরে ১০ জন খুচরা ব্যবসায়ী ও বিশ্বম্ভরপুরে ১৮ জন খুচরা চাল ব্যবসায়ী রয়েছেন।
একজন মিল মালিক সাধারণত দুটি লাইসেন্সের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। ফুড গ্রেইন লাইসেন্স দিয়ে মিলে চাল মজুদ ও ক্রয় বিক্রয় করে থাকেন। অন্যদিকে মিলিং লাইসেন্সের মাধ্যমে ধান-চাল ভাঙানোর কাজ করেন। আর খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। কথা বলে জানা যায়, খাদ্য বিভাগের লাইসেন্স গ্রহণ করতে খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনীহার পরিমাণ বেশি। তারা মনে করেন, শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই চালের ব্যবসা করা যায়। অকাল বন্যায় ফসলহানির পর চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নবায়ন করতে জোর তৎপরতা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা ও উপজেলা খাদ্য বিভাগ ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স দিতে তৎপর হয়। তবে অকাল বন্যায় ফসলহানির কারণে জেলার সর্বত্র ধান চালের সংকট দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লাইসেন্স নিয়ে তাদের মধ্যে অনীহা রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কোনও চাল নেই বাজারে। শুধু আমদানি করা চালের ওপর নির্ভর করছেন জেলার বেশিরভাগ চাল ব্যবসায়ী। অন্যান্য বছর বৈশাখ মাসের শুরুতেই মিলগুলো ধানে পরিপূর্ণ থাকতো। এসময় কয়েক হাজার ফড়িয়া ব্যবসায়ীও ধানের ব্যবসা করতেন। তবে এবার বন্যার কারণে জেলার মিলে কোনও ধান নেই। মিলগুলো প্রায় বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উচ্চমূল্যে দেশীয় চাল ও আমদানি করা চাল দিয়ে বাজারের চাহিদা পূরণ করছেন। দ্বিতীয় দফা বন্যায় জেলার আমন ধান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবছর মিল মালিকরা নতুন ফসল ঘরে ওঠার আগ পর্যন্ত আর তাদের মিলগুলো চালু করতে পারবেন না বলেও আশঙ্কা করছেন। এরই মধ্যে এখন হঠাৎ করে লাইসেন্স নবায়ন শুরু হওয়ায় মিল মালিকরা অনেকটা বিপাকে পড়েছেন। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের চাপের মুখে লাইসেন্স নবায়ন করলেও এর প্রভাব পরবে স্থানীয় ক্রেতাদের ওপর।
সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক শংকর দাস বলেন, ‘ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কৃষকের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দাভাব বিরাজ করছে। খাদ্য বিভাগের লাইসেন্স নবায়ন করায় খুচরা ব্যবসায়ীরা চাপের মুখে পড়বেন। এতে চালের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।’অন্যদিকে, সুনামগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, ‘সারা জেলায় খুচরা ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ীদের যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে, তারচেয়ে ব্যবসায়ীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হবে। উপজেলা খাদ্য বিভাগ সঠিকভাবে ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করলে এ খাতে কিছু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। যে কেউ চালের দোকান খুলে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারবে না।’দোয়ারাবাজার উপজেলার মোহব্বতপুর বাজারের হযরত জমির শাহ সেমি অটো রাইছ মিলের মালিক হানিফ আলী বলেন, ‘দুই পয়সা ব্যবসা নাই। তার ওপর আবার লাইসেন্স নবায়ন করায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কেউ কেউ ঋণ করে টাকা নিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করছেন।’সদর উপজেলার পাইকারী চাল ব্যবসায়ী মো. আলফাজ উদ্দিন বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চাল সংগ্রহ করে কোনও রকমে দোকান চালু রেখেছি। লাইসেন্স নবায়ন করায় আমাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে।’
শহরের জেল রোড এলাকার চাল ব্যবসায়ী প্রণয় পাল টিটু বলেন, ‘সদরের সব ব্যবসায়ী খাদ্য বিভাগের চালের লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করেন। লাইসেন্স নবায়ন করায় বাজারে চালের দাম কমবেও না বাড়বেও না। যদি দেশের বিভিন্ন এলাকার চাল ব্যবসায়ী ও আমদানি কারকরা চালের দাম না কমান তাহলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’এবছর গোটা হাওর এলাকায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া বড় বড় কৃষক থেকে শুরু করে মিল মালিকদের ঘরে চাল নেই। ধান না থাকায় ব্যবসাও নেই বলে মন্তব্য করে ছাতক উপজেলার হাজী সেমি অটোমেটিক রাইস মিলের মালিক শামছুন নাহার বলেন, ’লাইসেন্স নবায়ন করলেই কী হবে আর না করলেই কী হবে। সরকার যদি লাইসেন্স ফি কমায় তাহলে মিল মালিকদের সুবিধা হতো। মিলে ধান না থাকায় তারা কর্মচারী ছাঁটাই করে দিয়েছেন।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের একজন কর্মচারী জানান, জেলার ছাতক ও দোয়ারাবাজারে লাইসেন্স ছাড়া চাল ব্যবসায়ীদের সংখ্যা অনেক বেশি। বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও তারা লাইসেন্স করতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে, জেলা ও উপজেলা খাদ্য বিভাগে জনবল সংকটের কারণে এ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেও একটি সূত্র জানায়।
দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলার ইউসিএফ মো. সাহাবুদ্দিন জানান, তাদের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা চালের লাইসেন্স করতে আগ্রহী নন। তাই তিনি মৌখিকভাবে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন। নির্ধারিত সময়ের পর যারা লাইসেন্স করবেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জাকারিয়া মোস্তফা বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেসব ব্যবসায়ী তাদের লাইসেন্স নবায়ন করবেন না, তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ’