মেঘালয় সীমান্তে ৪০ হাজার বাংলাদেশী আতঙ্কে
সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী তাহিরপুর উপজেলার লাউড়েরগড় ঘেঁষা যাদুকাটা নদী, টেকেরঘাট, বড়ছড়াসহ আশপাশের গ্রামগুলো ক্রমেই মানুষের বসবাস ও চাষবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। পাহাড়ের পাদদেশের পাঁচ গ্রামের অন্তত ৪০ হাজার মানুষের আবাদী জমি ও বাড়িঘর পাহাড়ি ঝর্নায় সৃষ্ট ঢলের সঙ্গে আসা বালি, পাথর ও কয়লার নিচে পড়ে গেছে। তবে এ সব বালির সঙ্গে রাসায়নিক তরলবর্জ্য প্রবাহিত হয়ে আসায় পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। নয়নজুড়ানো খাসিয়া পাহাড়ের অসংখ্য ঝর্না এখন পাদদেশের জনপদের জন্য এক আতঙ্ক। বিশেষ করে বৃষ্টি নামলেই এলাকার মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে কখন কোন দিকে ঢল নামে আর জনপদ ভাসিয়ে নেয়।
এর অন্যতম কারণ পাহাড়ে অপরিকল্পিত কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলন। বিশেষ করে সীমান্তের ওপারের কয়লা খনিতে মাইনিং-এর মাধ্যমে খনিজ দ্রব্য উত্তোলনে ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ক্ষতিকারক কয়লা উত্তোলনে মাইনিং বন্ধের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর ‘মেঘালয়ের পাহাড় ধসের ফলে নির্গত বালি ও পাথর দ্বারা আবাদি জমি নষ্ট এবং পরিবেশ বিপর্যয় রোধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। অন্যদিকে এ বিপর্যয় রুখতে ২০০৮ সালের নভেম্বর সুনামগঞ্জ ১৭ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের পক্ষে ভারতের শিলং ৮৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের বৈঠক হয়। বৈঠকে অপরিকল্পিতভাবে ভারতের ফরেস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী পাহাড় খোঁড়া বন্ধের জন্য বলা হয়। বৈঠকে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বালি, পাথর এসে গাছপালা মারা যাচ্ছে এবং ফসলি জমি বালির নিচে চাপা পড়েছে। অন্যদিকে ভারতের পরিবেশবাদী সংগঠনও অপরিকল্পিত কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধে সোচ্ছার। তারা এ বিষয়ে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাই মাঝে মধ্যে ভারতের আদালতের নির্দেশে কয়লা উত্তোলন বন্ধ থাকে। গত কয়েকদিন থেকে বড়ছড়া দিয়ে কয়লা আমদানি আবারো বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছর থেকেই পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই বালির সঙ্গে তরল বর্জ্য আসে। এলাকাটি পাহাড়ের পাদদেশে থাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষে বৃষ্টির সময় প্রবল বেগে নেমে আসা ঢল ঠেকানো অসম্ভব। আবার ঢলের কারণে গত কয়েক বছরে শতশত বাড়িঘর উচ্ছেদ হয়ে গেছে। সেই স্থানে আর বসতি স্থাপন করতে পারছেন না এলাকাবাসী। বছরের পর বছর এ ভাবে নেমে আসা ঢলের সঙ্গে তরল বর্জ্য মিশ্রিত বালি আসার ফলে দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের উর্বরা জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি ঐ সব জমিতে এখন ঘাসও জন্মে না। বালির সঙ্গে এক ধরনের তরল রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত থাকায় এ বালি কিনতেও কেউ আগ্রহী নয়। অথচ অদূরেই যাদুকাটা নদীর বালির চাহিদা দেশব্যাপী।
তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, বালির আগ্রাসন দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে। পরিবেশের জন্য মরাত্মক হুমকি হয়ে পড়েছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সমস্যা আরো তীব্র হবে।
নয়াছড়া, রজনীলাইন, বুরুঙ্গা, লাকমা, ভাঙ্গের ঘাট, বড়ছড়া দিয়ে বর্ষায় বালির সঙ্গে রঙ্গিন পানি নামছে— এ তথ্য জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, কোনো কোনো সময় লাল, কালো ও কমলা রঙের পানি নামে। সরেজমিনে বড়ছড়ার পানি দেখতে স্বচ্ছ মনে হলেও এর স্বাদ বিদঘুটে। রজনীলাইন গ্রামের আরশাদ মিয়া জানান, ‘ছড়ার এ পানিতে গোসল করলে শরীর চুলকায়। মাথার চুল পড়ে যায়। রজনীলাইন গ্রামের যুবক মুহাম্মদ আলী বলেন, ‘অধিকাংশ ছড়ার পানি ব্যবহার করার মতো নয়। খাওয়া যায় না। অনেক সময় কাদাযুক্ত থাকে। কাপড় ধোয়াও যায় না।
ভারতীয় বিশেষজ্ঞ বেনথি সংলাং বেলাওয়ার ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে তার একটি গবেষণাপত্রে লিখেছেন, যেসব এলাকায় কয়লা খনি রয়েছে, সে এলাকায় এসিড মাইন ড্রেনেজের কারণে পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। তিনি বলেন, কয়লা খনি থেকে যে অম্ল পানি নেমে আসে তা ক্ষতিকর। তিনি বলেন, এ ধরনের জটিল ভূমিতে ভারতীয় সরকার অপরিকল্পিতভাবে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করছে। এতে প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ভূমি ধস ও তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।