লন্ডন: ম্যানচেস্টারে গত ২২শে মে’র হামলার পর ব্রিটেনের নির্বাচনী প্রচারণায় কিছুটা হলেও তার প্রভাব পড়েছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাদের প্রচারণায় তুলে আনতে হচ্ছে নিরাপত্তার মতো ইস্যু। হামলাকারী মুসলিম হওয়ার কারণে স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে সামান্য শঙ্কা তৈরি হলেও শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশরা বলছেন, কোন ধর্মের বা বিশ্বাসের মানুষের এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। খবর বিবিসির। ম্যানচেস্টারে রেল স্টেশনে গিয়ে নামলেই টের পাওয়া যায় শহরটি অস্বস্তিতে আছে। মাইকে সারাক্ষণই ঘোষণা করা হচ্ছে সন্দেহজনক কিছু দেখলে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে। ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চারদিকে পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি। ১০ কিলোমিটার ম্যারাথনের কারণে ছুটির দিন রবিবারেও শহরটি মানুষে গিজগিজ করছে। রাস্তাতেও প্রচুর পুলিশ। কখনো মনে হয় ম্যারাথনে অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় পুলিশের সংখ্যাও যেনো কম নয়। শপিং মলগুলো দারুণ ব্যস্ত। শহরের রাস্তাতেও কেউ খেলা দেখিয়ে আবার কেউ ড্রাম বাজিয়ে পথচারীদের দৃষ্টি কাড়ছেন। অনেক মানুষের গন্তব্য ম্যানচেস্টার এরিনার দিকে। এরিনাতে যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে পুলিশ।

গত ২২শে মে এই এরিনাতেই কনসার্ট চলছিলো। মার্কিন শিল্পী আরিয়ানা গ্রান্ডে তার অনুষ্ঠান শেষ করার সাথেই সেখানে বিস্ফোরণ ঘটায় এক তরুণ। এতে ২২ জন প্রাণ হারায় যাদের বেশিরভাগই শিশু। এরপর থেকে এই কনসার্ট হলের চারপাশে পুলিশ ঘিরে রেখেছে। ফিতে দেওয়া হয়েছে পুলিশ লাইন। কাউকে ফিতের ওপাশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনটি প্রবেশ পথের সবকটিই বন্ধ। ম্যানচেস্টারের এই হামলার পর ব্রিটেনের মুক্ত ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও কি এই ঘটনা কোন ধরনের বিধিনিষেধ টেনে দিতে পারে? কি প্রভাব পড়তে পারে আগামী বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের ওপর। ম্যারাথনে দৌড়াতে এসেছেন জেনেট লো। শহরের কাছেই থাকেন তিনি। প্রতিবছরই আসেন তিনি। কিন্তু বলছিলেন, এবার তার দৌড়ানোটা অন্যরকম। ‘ভয়ঙ্কর ঘটনা। কিন্তু তারা আমাদের পরাজিত করবে সেটা আমরা হতে দিতে পারি না।’ ম্যারাথনে দৌড়াতে আসা  জুলি ক্লার্ক বলেন, ‘এখন আমাদের সবাইকে নিয়ে বসতে হবে। রাজনীতিতেও এর একটা বড় প্রভাব পড়বে। নির্বাচনের সময়েও এটা নিয়ে ভাবতে হবে। আমি মনে করি সবকিছু নিয়ে নতুন করা চিন্তাভাবনার প্রয়োজন।’ এসেছেন ফ্যাশন ডিজাইনার জুলি ক্লার্ক। এই প্রথমবারের মতো ১০ কিলোমিটার দৌড়াবেন তিনি।

জুলি ক্লার্ক বললেন, যে দলই নির্বাচনে জিতুক, এতে ভালো বা মন্দ কিছুই হবে না। ‘কিন্তু তারপরেও চেষ্টা করতে হবে এরকম বীভৎস ঘটনা যাতে আর না ঘটতে পারে। এই হামলার ঘটনা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচার করার কিছু নেই। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সামনের দিকে এগুতে হবে। আমি মনে করি, ম্যানচেস্টার সারা বিশ্বের সামনে এক নজির সৃষ্টি করবে,’ বলেন তিনি। কথা হচ্ছিলো ২১ বছর বয়সী মেডিসিনের এক ছাত্রের সাথেও। তার জন্ম ম্যানচেস্টারে। হামলার রাতে তিনি এই শহরেই ছিলেন। বললেন, ২২ তারিখ রাত সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। ‘তবে আমি বিশেষ কিছু তিক্ততা অনুভব করছি না। কারণ পৃথিবীটা এখন এভাবেই চলছে। এধরনের হামলার ঘটনা ঘটবে। হবে তার প্রতিক্রিয়াও। মনে রাখতে হবে আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি। এই ঘটনা ব্যালট বক্সে কোন প্রভাব ফেলবে না। কারণ এর ফলে মানুষের মতামতের কোন পরিবর্তন ঘটবে না। বরং যার যে মত সেটাই হয়তো আগের তুলনায় আরো শক্ত হবে,’ বলেন তিনি। গ্রেটার ম্যানচেস্টারে বসবাস ৪০ হাজারের মতো বাংলাদেশী। হামলাকারী মুসলমান হওয়ায় বাংলাদেশীসহ স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে কিছুটা হলেও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বলে বললেন স্থানীয়দের অনেকেই। গিয়েছিলাম আরব মুসলিম অধ্যুষিত রুশাম এলাকায় বাংলাদেশীদের পরিচালিত শাহজালাল মসজিদে। সেখানে প্রতিদিন ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে।

একশোরও বেশি মানুষ প্রতিদিন এখানে ইফতার করেন। আমিও সেদিন ইফতার করতে গিয়েছিলাম। তখন কথা হচ্ছিলো মসজিদের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা গোলাম মোস্তাফা চৌধুরীর সাথে। তিনি ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছেন ম্যানচেস্টারে। তিনি বললেন, হামলার পর থেকে তারা কিছুটা ভয়ে আছেন। ‘বিভিন্ন স্থানে শ্বেতাঙ্গরা আমাদের হেয় চোখে দেখছেন। এজন্যে তারাবির নামাজের সময় মসজিদের বাইরে পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছে।’ এর ফলে কি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে? আরো অনেকের মতো একজন মুসুল্লি মীর গোলাম মোস্তফাও জানালেন যে এরকম হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন এবং তার মতে ‘সেটাই স্বাভাবিক। এরকম কিছু হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’ ম্যানচেস্টার এরিনার খুব কাছেই সেন্ট অ্যান চত্বরে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ফুল দিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে নিহতদের স্মরণ করছে।

ব্রিটিশ মুসলিম ফোরামের নেতা, ম্যানচেস্টার কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ইরফান চিশতিও সেখানে এসেছিলেন সংহতি জানাতে। তিনি বলেছেন, কি হয় সেটা দেখতে হবে। ‘প্রথম দিন দক্ষিণপন্থী দল ই ডি এল বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেছিলো। লোকজন তাদেরকে চিৎকার করে থামিয়ে দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, শেষ পর্যন্ত মানুষ কিন্তু ভালো। এবং এই ভালোটাই টিকে থাকবে।’ ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া চত্বরটিতে অনেকটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন জুলি। কিছুক্ষণ আগে ফুল দিয়ে এসেছেন তিনি। পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন তার স্বামী – পিট। জুলি কিছুক্ষণ পরপরই তার চোখের পানি মুছছিলেন। কান্না মেশানো গলায় বলছিলেন, কোন ধর্মের মানুষের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ‘এই ঘটনা সবাইকে একত্রিত করবে। দেখুন বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষ এখানে জড়ো হয়েছেন। আমার মনে হয়, দুঃখজনক এই ঘটনা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ স্বামী পিটও একই সুরে বললেন, ‘দেখুন, এখানে সবাই সবার বন্ধু। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে কথা বলছেন। ভালোবাসছেন। এই ঘটনা পেছনে ফেলে আমরাও অগ্রসর হবো। কিন্তু কখনো ভুলবো না। সবাই একজোট হলে সবকিছু পরাজিত করা সম্ভব।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn