যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যৎ যে পথে
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আইনপ্রণেতা প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র ব্রেক্সিট পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও বুধবারের (১৬ জানুয়ারি) আস্থাভোটে তার টিকে যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। এমন বাস্তবতায় প্রত্যাখ্যাত ব্রেক্সিট খসড়া অথবা একই ধারার কোনও পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ভোটাভুটির আহ্বান জানাতে পারে তার দল। থেরেসা মে সেই দফাতেও যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতার সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হন, সেক্ষেত্রে আরও কিছু পথ খোলা রয়েছে।
১. চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের চুক্তি অনুযায়ী, ২৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যুক্তরাজ্য বিকল্প কোনও পদক্ষেপ না নিতে পারলে কোনও চুক্তি ছাড়াই (নো ডিল) নির্ধারিত দিনে সম্পর্ক ছিন্ন হবে। ব্রিটিশ সরকার চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে কিছু আইন পাস করতে চাইতে পারে। তবে তা অত্যাবশ্যক নয়। অবশ্য নো ডিল ব্রেক্সিটের (চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট) প্রাপ্তি নিয়েও ব্রিটিশ এমপিদের অনেকের মধ্যে হতাশা রয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি পার্লামেন্টে উত্থাপিত সরকারের একটি কর বিল আটকে দিয়েছে তারা। বিলটি পাস না হওয়ার কারণে নো ডিল ব্রেক্সিটের পর নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে কর বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে। এ পদক্ষেপকে প্রতীকী হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, টাকা তুলতে অন্য পথ খুঁজে নিতে পারবে সরকার। তবে বিলটি পাস না করার মধ্য দিয়ে এ ইঙ্গিত মিলেছে যে, এমপিরা নো ডিল ব্রেক্সিটকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করবেন।
২. পুনঃ আলোচনা
আরেকটি বিকল্প পথ হিসেবে সম্পূর্ণ নতুন একটি ব্রেক্সিট পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রস্তাব দিতে পারে থেরেসা মে সরকার। এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে এবং ব্রেক্সিট বিলম্বিত করতে এ সংক্রান্ত আইন ‘আর্টিকেল ৫০’-এর সংযোজন (এক্সটেনশন) লাগবে। এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যকে দুইটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, সময়সীমা বাড়ানোর জন্য ইইউ-এর কাছে আবেদন জানাতে হবে। ইউরোপীয় কাউন্সিলে আয়োজিত ভোটাভুটিতে সবগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের সমর্থন পেলেই কেবল ব্রেক্সিট বিলম্বিত করা যাবে। দ্বিতীয়ত, ইইউ উইথড্রয়াল অ্যাক্টে ‘বিচ্ছিন্ন হওয়ার দিন’র সংজ্ঞা পরিবর্তনের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এ তারিখ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভোটাভুটিতে অংশ নিতে পারবেন ব্রিটিশ এমপিরা। তবে নতুন আলোচনায় অংশ নিতে ইইউ রাজি না হলে ব্রিটিশ সরকারকে অন্য উপায় খুঁজতে হবে।
৩.আরেকটি গণভোট ও প্রতিবন্ধকতা
সরকার ব্রেক্সিট প্রশ্নে নতুন একটি গণভোটেরও আয়োজন করতে পারে। তবে গণভোট আয়োজনের ক্ষেত্রেও কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেগুলো ২৯ মার্চের আগে শেষ করা সম্ভব হবে না। পলিটিক্যাল পার্টিজ, ইলেকশন্স অ্যান্ড রেফারেন্ডামস অ্যাক্ট ২০০০ নামক আইনে গণভোটের জন্য বেঁধে দেওয়া বিধি অনুযায়ীই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। গণভোটের জন্য নতুন একটি আইন তৈরি করতে হবে এবং এর আওতায় বিধিগুলো ঠিক করতে হবে। যেমন-কারা ভোট দিতে পারবে। গণভোটে কোন প্রশ্নটি করা হবে তা ঠিক করতে নির্বাচন কমিশনকেও সময় দিতে হবে। আইনটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে গণভোট আয়োজন করা যাবে তাও নয়। ভোটগ্রহণের আগে সংবিধিবদ্ধ ‘গণভোটকালীন সময়’ পার করতে হবে। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের সংবিধান বিভাগের বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে বিবিসি জানিয়েছে, সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২২ সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। সে সময়সীমা খানিক কমিয়ে আনা হলেও মার্চের মধ্যে তা সম্ভব হবে না।
৪. সাধারণ নির্বাচন আহ্বান
অচলাবস্থা নিরসনে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে নিজেও আগাম নির্বাচনের ডাক দিতে পারেন। তবে নির্বাচনের ডাক দেওয়া ছাড়া তার অন্য ক্ষমতা থাকবে না। ২০১৭ সালে ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্টস অ্যাক্ট-এর আওতায় এমপিদেরকে আগাম নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। প্রস্তাবটি পাসে দুই-তৃতীয়াংশ এমপির সমর্থন থাকতে হয়।
৫. অন্যান্য সম্ভাবনা
গত ১০ ডিসেম্বর ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস (ইসিজে) এর এক রুলে বলা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এর বাকি ২৭ সদস্যের অনুমতি ছাড়াই একতরফাভাবে ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবে যুক্তরাজ্য। তবে ব্রেক্সিটের প্রশ্নে সরকার এখনও বদ্ধপরিকর। সে জায়গা থেকে ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত বাতিলের আগে গণভোট কিংবা সরকার পরিবর্তনের মতো পদক্ষেপগুলো সামনে আসতে পারে। কিছুদিন আগে দলীয় নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জে টিকে গেছেন থেরেসা। কনজারভেটিভ পার্টির নিয়ম অনুযায়ী, এক বছর তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো যাবে না। তবে থেরেসা নিজে থেকে চাইলে পদত্যাগ করতে পারেন। তখন কনজারভেটিভ পার্টি থেকে নতুন একজনকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। তবে যিনিই প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন ব্রেক্সিট প্রশ্নে একই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে তাকে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী মে যে আস্থা ভোটে উতরে যাবেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত। দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ বলছে, বুধবার থেরেসা মে’র বিরুদ্ধে ডাকা আস্থা ভোটে লেবারদের জয় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। থেরেসা মে-এর দল কনজারভেটিভ পার্টির অনেক এমপি তার ব্রেক্সিট পরিকল্পনাকে সমর্থন না দিলেও তারা সাধারণ নির্বাচন আয়োজনে আগ্রহী নয়। তাছাড়া, তারা চান না, নির্বাচনের মাধ্যমে লেবার পার্টিকে সরকার গড়ার সুযোগ করে দিতে। সেদিক থেকে লেবার নেতা করবিনের জন্য কনজারভেটিভদের সমর্থন পাওয়াটা দূরাশা। তাছাড়াও থেরেসা মে’র ডিইউপি জোটের অংশীদার দলগুলো ব্রেক্সিট চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিলেও আস্থা বোটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পাশেই থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা।
ব্রেক্সিটপন্থী এমপিদের যারা থেরেসার চুক্তিকে সমর্থন দেননি তারাও বলেছেন আস্থা ভোটে তারা থেরেসাকেই সমর্থন দেবেন। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে থেরেসা অন্তত এ পর্যায়ের আস্থা ভোটের সম্ভাব্য ফল নিয়ে স্বস্তিতেই থাকতে পারেন।