যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনে হচ্ছেটা কী?
আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য :: যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনে বিএনপির হামলা ও বঙ্গবন্ধুর ছবি অবমাননার ঘটনা, মেয়াদোত্তীর্ণ কর্মকর্তাদের দাপট, দায়িত্বে অবহেলা ইত্যাদি কারণে বেশ বেকায়দায় যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ হাইকমিশন। জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ছবি অবমাননার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার কারণে ডেপুটি হাইকমিশনার খন্দকার তালহার বিদায় হলেও বাংলাদেশে গিয়ে সম্প্রতি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন হাইকমিশনার নাজমুল কাওনাইন। নাজমুল কাওনাইন ঘটনার দিন কেন লন্ডনে স্টেশনে ছিলেন না সেটি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে তদন্ত কমিটি। ৮ ফেব্রুয়ারি আইরিশ সরকারের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করার তারিখ থাকলেও তার দুই দিন আগে ৬ ফেব্রুয়ারি কেন সরকারি টাকার অপচয় করে তিনি ডাবলিন গেলেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উল্লেখ্য লন্ডন স্টানস্টেড, গ্যাটউইক বা সিটি এয়ারপোর্ট থেকে ডাবলিনের ফ্লাইটে সময় লাগে মাত্র ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। লন্ডন থেকে বা ডাবলিন থেকে প্রায় প্রতিদিন অসংখ্য লোকজন দিনে দিনে তাদের অফিশিয়াল বা ব্যবসায়িক কাজ শেষ করে আবার ফিরে যায়।
এদিকে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা ও বঙ্গবন্ধু ছবি অবমাননার ঘটনার পর দাবি করেছিলেন, তারা হাইকমিশনারের হাতেই স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য সময় চেয়েছিলেন যা দুবার পরিবর্তন করে ৭ তারিখ দেওয়া হয়। অথচ সেদিন হাইকমিশনার ছিলেন না। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলেছেন, বড় ধরনের কিছু হতে পারে আঁচ করেই ডাবলিনে কাজের দুই দিন আগেই সরকারি কাজে চলে যান হাইকমিশনার। অথচ তিনি ৭ তারিখ বিকালে গেলেও পারতেন। তিনি থাকলে এত বড় ঘটনা হয়তো সামাল দেওয়া যেত। এদিকে অদৃশ্য শক্তির কারণে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ হাইকমিশনের দুজন কর্মকর্তা ফার্স্ট সেক্রেটারি ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম কবির ও ফার্স্ট সেক্রেটারি পাসপোর্ট শাখার কর্মকর্তা শিরিন আখতার দীর্ঘদিন আগেই মেয়াদ শেষ হলেও তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন এখানে। এরা দীর্ঘদিন এখানে থাকায় বিভিন্ন সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন।
জানা গেছে মনিরুল ইসলাম কবির তিন বছর মেয়াদে যুক্তরাজ্য মিশনে যোগ দেন ৮ জানুয়ারি ২০১৪ সালে। স্ত্রী ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর মানসিক বিপর্যস্থ ইত্যাদি অজুহাতে তিনি এখনো রয়ে গেছেন যুক্তরাজ্য মিশনে। বর্তমানে কবির বলছেন, স্ত্রী মৃত্যুর জন্য হাসপাতালকে দায়ী করে তিনি আইনি লড়াই করতে চান এবং এ জন্য তার ব্রিটেনে থাকা জরুরি। সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ব্রিটেন থেকে শতাধিক সংগঠন এখানে ফান্ড রেইজিং করে বাংলাদেশে অবৈধভাবে সরকারের অনুমোদন ছাড়া টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের নির্দেশনা থাকলেও হাইকমিশনের ওয়েলফেয়ার শাখার ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং বাংলাদেশ থেকে কোনো সংস্থার ব্যাপারে কোনো রিপোর্ট চাইলে কবির আহমদ টাকার বিনিময়ে সেটা পজেটিভ করে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। পাসপোর্ট শাখার কর্মকর্তা শিরিন আখতার ৩১ অক্টোবর ২০১১ সালে ব্রিটেনে যোগ দেন। শিরিন আখতারের স্বামী বাংলাদেশে বিডিআর বিদ্রোহের সময় নিহত হন এবং তখন বিসিএস ক্যাডার শিরিন আখতারকে ব্রিটেন মিশনে পাঠানো হয়। ৪ বছর আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও তিনি কীভাবে দায়িত্বে আছেন এখনো সেটা নিয়ে প্রশ্ন খোদ হাইকমিশনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের। দীর্ঘদিন ব্রিটেনে থাকায় অনেকটা স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
নিয়মিত অফিস কামাই, পাসপোর্ট সমস্যার জন্য যাওয়া প্রবাসীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করাসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে শিরিন আখতারের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তভোগী জানান, গত ১২ ফেব্রুয়ারি তার নিজের পাসপোর্ট নিয়ে তিনি শিরিন আখতারের সঙ্গে কথা বলেই সব প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে গিয়েছিলেন। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে শিরিন আখতার এসে কাগজপত্র দেখে তার সঙ্গে বলেন, দুপুর ১টার মধ্যে আরও একটি কাগজ নিয়ে আসতে হবে। তখন তিনি বেশ রূঢ় ব্যবহার করেন। এরপর শারমীন আবারও দুই ঘণ্টা জার্নি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাগজ নিয়ে গেলেও শিরিন আখতারকে আর পাননি। শিরিন আখতারের মোবাইলে ফোন করলে তিনি আবারও খারাপ ব্যবহার করেন। এরপর আরেকজন কর্মকর্তা এসে কাজটি করে দেন। শারমিন অভিযোগ করেন, শিরিন আখতারের সঙ্গে কথা বলেই সব কাগজ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া শিরিন আখতারের কোনো রাইট নেই রূঢ়ভাবে কথা বলার। এ ছাড়া শিরিন আখতারের বিরুদ্ধে নানু চৌধুরী নামের একজনের ডিজিটাল পাসপোর্ট অন্যজনকে দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে নানু চৌধুরী নামে একজন কর্মজীবী সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশি ডিজিটাল পাসপোর্ট বানানোর জন্য তার পুরনো হাতে লেখা পাসপোর্ট জমা দিলে দেখা যায় ইতিমধ্যেই নানু চৌধুরীর সব তথ্য ব্যবহার করে জাল কাগজপত্র দিয়ে ইতিমধ্যে ডিজিটাল পাসপোর্ট বানিয়ে সেটি অন্য কেউ ব্যবহার করছে। ধারণা করা হচ্ছে, পাসপোর্ট জালিয়াতের একটি চক্রের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কাজটি করা হয়েছে। যদিও হাইকমিশন থেকে এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেওয়া হয়নি কখনই। তবে নানু চৌধুরীর সেই সমস্যার সমাধান পরে হাইকমিশন থেকে করা হয়েছে। কিন্তু প্রায় বছর খানেক নানু চৌধুরীর বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, শিরিন আখতারের বর্তমান স্বামী একজন সাংবাদিক। তাই তার দাপটে তটস্থ থাকে সবাই। তিনি ইচ্ছামতো অফিসে আসেন-যান এটা নিয়ে কথা বলার কেউ নাই।