রাজশাহীতে বসে ঢাকার অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরিকল্পনা করেছিল সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ ওরফে শাহাদত। যাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। যিনি হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনাকারি ও গ্রেনেড সরবরাহকারী ছিলেন।  মাহফুজসহ চারজনকে গ্রেফতারের বিষয়ে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি খুরশীদ হোসেন শনিবার দুপুরে সাংবাদিক ব্রিফকালে তিনি বলেন, জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবির শীর্ষ নেতা মাহফুজের রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় ৩০০ অনুসারি রয়েছে। তাদের ধরতে রাজশাহী অঞ্চলে পুলিশের সাড়াশি অভিযানের জালে পড়েন মাহফুজ। শনিবার ভোররাত তিনটার দিকে শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের পুষকিনি এলাকার একটি আমবাগান থেকে তিন সহযোগিসহ মাহফুজকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোপন মিটিং করে স্থান পরিবর্তনের সময় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।

সোহেল মাহফুজের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার সাদিপুর কাবলিপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম রেজাউল করিম। তার তিন সহযোগিরা হলেন, নব্য জেএমবির আইটি স্পেশালিস্ট শিবগঞ্জের আফজাল হোসেনের ছেলে হাফিজুর রহমান হাফিজ, শিবগঞ্জ উপজেলার পার্বতীপুরের চকমোহনপুর গ্রামের ইয়াছিন আলীর ছেলে অস্ত্র সরবরাহকারী মোস্তাফিজুর রহমান জামাল এবং একই উপজেলার বিশ্বনাথপুর কাটিয়াপাড়া গ্রামের এসলামের ছেলে জুয়েল।

ডিআইজি এম খুরশীদ হোসেন বলেন, সোহেল মাহফুজ বোমা বিশেষজ্ঞ ও নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। জেএমবির হামলায় সে অস্ত্র ও বোমা সরবরাহ করে থাকে এবং দীর্ঘদিন যাবৎ মাহফুজ রাজশাহী অঞ্চলে অবস্থান করে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছিল। মূলতে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, বগুড়া ও গাইবান্ধায় তার চলাফেরা ছিল। এর মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর ও বাগমারায় বেশী অবস্থান করতো মাহফুজ। আমরা তাকে দীর্ঘ দিন ধরেই টার্গেট করছি। অবশেষে তিন সহযোগীসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে তাকে ধরা হয়েছে। সোহেলকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক তছনছ হয়ে গেল বলেন ডিআইজি খুরশীদ হোসেন।

রাজশাহী অঞ্চলে মাহফুজের প্রায় ৩০০ বেশি অনুসারি রয়েছে। মাহফুজসহ তার অনুসারিদের গ্রেপ্তারে গত তিনদিন থেকে এ অঞ্চলে সাঁড়িশী অভিযানে নামে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। তাদের এ অভিযানে ঢাকা থেকে আসা কাউন্টার টেরিরিজম ইউনিটের সদস্যরা সহযোগিতা করছে বলে জানান ডিআইজি।

কে এই জঙ্গি সোহেল মাহফুজ? কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার সাদিপুর কাবলিপাড়া গ্রামের রেজাউল করিম সোহেল মাহফুজ ২০০৫ সালের দিকে জেএমবির সাবেক শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের আমলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। তার জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি হয় শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের আমলে। পরে জেএমবির শীর্ষ ৬ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হলে সংগঠনটির জেএমবির শুরা (নীতি নির্ধারণী) কমিটির সদস্যপদ পান মাহফুজ। এরপর ২০১০ সালের দিকে তখনকার জেএমবির প্রধান সাইদুর রহমান গ্রেপ্তার হলে নিজে আত্মগোপনে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উত্তরাঞ্চলে জেএমবিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন মাহফুজ।

২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে আদালতে নেয়ার পথে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন এই সোহেল মাহফুজ। মাহফুজের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে নিহত নব্য জেএমবির সমন্বয়ক ও গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। মূলত তার আহ্বানে নব্য জেএমবিতে যুক্ত হয় তিনি। এরপর থেকে তিনি নব্য জেএমবির অস্ত্র কেনা, গ্রেনেড তৈরি এবং সরবরাহসহ আইটি শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বোমা তৈরি করতে গিয়ে সোহেল মাহফুজের বাঁ হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এক হাত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে দক্ষ তিনি।

কে এই জঙ্গি মাহফুজ?

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরায় হামলার পর পরিকল্পনাকারী হিসেবে যে কয়েকটি নাম ওঠে এসেছে তার মধ্যে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাটকাটা সোহেলের নাম অন্যতম। ডান হাতের কব্জিহীন এই জঙ্গি নেতাকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইও দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছিল। ওই গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, ২০১৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খগড়াগড়ে বোমা বানাতে গিয়ে যে বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়েছিল তার সঙ্গে সোহেল মাহফুজের সম্পৃক্ততা রয়েছে। শুধু সোহেল মাহফুজ নয়, এ ঘটনায় বাংলাদেশের জেএমবির ডজনখানেক নেতাকে খুঁজছে এনআই।

শুক্রবার চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে সোহেল মাহফুজকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও জেলা পুলিশ। সিটিটিসির দাবি দাবি সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শিবগঞ্জের পুষ্কনি এলাকার একটি আম বাগান থেকে চার সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিটিটিসি সূত্র থেকে জানা যায়, জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে আব্দুর রহমান বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতো সোহেল মাহফুজ। সাংগঠনিক তিনি জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। ২০০৪ সালে যখন রাজশাহীর বাঘমারা উপজেলায় বাংলা ভাইয়ের সর্বহারা পার্টি বিরোধী অভিযান চালানো তখন কোনো এক বিস্ফোরণের সময় তার ডান হাতের কব্জি উড়ে যায়। এরপর থেকে সোহেল মাহফুজ ভারতে পালিয়ে যান ও গোপনে আশ্রয় নেয়।

সোহেল মাহফুজ ভারতে জেএমবির ‘ভারত শাখা’ খুলেন এবং প্রথম আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খগড়াগড়ের একটি বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে দুই জেএমবি নেতা নিহত হন; যারা জেএমবির ভারত শাখার সদস্য ছিলেন । ওই ঘটনার পর জেএমবির ভারত শাখার খবর সবার সামনে আসে।

ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার সোহেল মাহফুজকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। এরপর সোহেল মাহফুজ বাংলাদেশে চলে আসেন এবং আত্মগোপনে চলে যান।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, যখন জেএমবির নতুন ধারা বা নব্য জেএমবি গঠিত হয় তখন সোহেল মাহফুজের বিচক্ষনতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন হিসেবে মজলিসে শূরা সদস্য পদ দেওয়া হয়। তিনি খুব একটা চলাফেরা করতেন না। কারণ, তার ডান হাতের কব্জি ছিল না। এতে করে তাকে সহজে চিহ্নিত করা যেত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন।

সোহলে মাহফুজ সম্পর্কে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গুলশান হামলার পরিকল্পনা প্রণয়নে সোহেল মাহফুজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র বিস্ফোরকগুলো ছোট মিজান বা অন্য কেউ বহন করেছিল, কিন্তু এগুলো আনা হয়েছে মাহফুজের পরিচালনায়।’

তিনি বলেন,  তাকে গ্রেপ্তার করায় (সোহেল মাহফুজ) গুলশান হামলার তদন্ত আরো একধাপ এগিয়ে গেল।গুলশান হামলার যে পাঁচজনতে আমরা খুঁজছিলাম সে তাদের মধ্যে একজন। এখনো নব্য জেএমবির আরো দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে গ্রেপ্তার করা গেছে গুলশান হামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া যাবে।

এদিকে খগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় সোহেল মাহফুজের সন্ধান চেয়ে এনআই বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছিল।  তবে সে সময় মাহফুজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অধরা থাকায় এনআইকে কোন সহযোগীতা করা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘তারা এর আগে কথা বলতে বেশ কয়েকবার আনষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে মাহফুজের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখিয়েছিল। এখন যেহেতু তাকে ধরতে পেরেছি সেহেতু তারা কথা বলতে চাইবে। তারা চাইলে আইনি প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেওয়া হবে। ’

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn