রাবির উপাচার্যের বক্তব্যে ভারতীয় স্লোগান ‘জয় হিন্দ’!
বার্তা ডেস্ক:রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে ভারতীয় স্লোগান দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন উপাচার্য এম আবদুস সোবহান। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার পর ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দিয়ে বক্তব্য শেষ করেছেন তিনি। অথচ উপাচার্যের আগে বক্তব্য দেওয়া রাজশাহীতে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার সঞ্জীব ভাটি নিজের দেশের স্লোগান দেননি। গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে তিন দিনব্যাপী ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগ ও জন ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক ওই সম্মেলনে রাজশাহীতে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার সঞ্জীব ভাটি বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য শেষ করলে সভাপতির বক্তব্য দেন উপাচার্য এম আবদুস সোবহান। তার বক্তব্যের বড় একটা অংশ জুড়েই ছিল ভারতীয়দের প্রশংসা। বক্তব্য শেষেও তিনি ভারতের স্লোগান ‘জয় হিন্দ’ বলেন। বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়ের বিপক্ষে উপাচার্যের এমন বক্তব্য ভালোভাবে নেননি কেউ। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে সমালোচনা। এমনকি সম্মেলনের আয়োজক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকরাও উপাচার্যের মুখে অন্য দেশের স্লোগান শুনে হতবাক হয়েছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে গত শুক্রবার থেকে আজ রোববার পর্যন্ত অন্তত ১০ বার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের মুঠোফোনে কল করা ও ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি বা ম্যাসেজের উত্তর দেননি। ওই অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পড়েন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি উপাচার্যের মুখে ওই স্লোগান শোনেননি জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কেউ এমনটা বলতে পারেন না।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার কিছুক্ষণ আগে সভাপতির বক্তব্য দেন উপাচার্য এম আবদুস সোবহান। তার বক্তব্যের শেষের শব্দ দুটি ছিল “জয় হিন্দ”। এর আগে আগে তিনি “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” বলেছেন।’ সম্মেলনে ভারতীয় উপস্থিতি সম্পর্কে ওই অধ্যাপক বলেন, ‘সম্মেলনে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খুব অল্পই এসেছিলেন, তিন-চারজন মনে হয়। আর সবই এসেছিল কলেজের শিক্ষক বা ফেলো। তাদের সামনে এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এভাবে ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান দেওয়া ঠিক হয়নি।’ ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সামাজিক নেতৃত্বের অংশ। সেই সামাজিক নেতৃত্বের বুদ্ধিজীবীরা যদি অপর রাষ্ট্রের প্রকাশ্য তোষামোদ করে, উপাচার্যের পদে থেকে কোনো ব্যক্তি যদি অপর রাষ্ট্রের তোষামোদ করে, তাহলে আমাদের জাতীয় সম্মান থাকবে কীভাবে? আমাদের চিন্তা-মননে যে জাতীয় পরিচয়, তার বিপক্ষে কথা বলেছেন উপাচার্য।’ ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সাবেক আহ্বায়ক অধ্যাপক রকীব আহমেদ। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভুল করে বক্তব্যে ভারতীয় স্লোগান দেওয়ার কথা নয়। উপাচার্য কী জন্য বক্তব্যে এমন স্লোগান দিলেন, সেই ব্যাখ্যা তিনিই ভালো দিতে পারবেন। একজন উপাচার্য এভাবে ভারতীয় স্লোগান বলতে পারেন কি না, এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল খালেক বলেন, ‘এভাবে “জয় বাংলা”র সঙ্গে “জয় হিন্দ” যোগ করা কাম্য নয়। যেহেতু উনি বলেছেন, উনি এর ব্যাখ্যা দিক।’
রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে উপাচার্য এভাবে অন্য দেশের স্লোগান দিতে পারেন কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট গবেষক ও ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের বড় বড় পর্যায়ে যারা চাকরি পায় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তারা সাধারণত যোগ্যতার চেয়ে বেশি দলের ভিত্তিতে পায়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কম যোগ্যতা সম্পন্ন, কম বুদ্ধি সম্পন্ন ও কম তাল-জ্ঞান সম্পন্ন মানুষরাই এসব বড় বড় পদে যায়।’ আফসান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষরা যদি “জয় পাকিস্তান” বলত, তাহলে কী হতো, এটা ওই উপাচার্যের (এম আবদুস সোবহান) ভেবে দেখা উচিত। তাহলে তো এটা দেশদ্রোহীতার পর্যায়ে চলে যেত। সাধারণভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আরেকটা দেশ সম্পর্কে এমনটা বলে সেটা তার অধিকার আছে। কিন্তু অন্যান্য যারা আছে, তাদের আরেক দেশের জয় (জয় হিন্দ) বলাটা সমীচীন না।’ ‘কালচার, পিস অ্যান্ড এডুকেশন : ফ্রম দ্য পারস্পেকটিভ অব পিপলস্ হিস্ট্রি’ শীর্ষক তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ। অনুষ্ঠানে জন ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক মেজবাহ কামাল স্বাগত বক্তব্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মর্ত্তুজা খালেদ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের পক্ষে ইন্ডিয়ান ইতিহাস কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক বোধ প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশিষ কুমার দাস ও বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশা ইসলাম নঈম শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। সম্মেলনের প্রথম দিনে চারটি প্লিনারি সেশনে দশটি মূল প্রবন্ধ ছাড়াও তেরটি টেকনিক্যাল সেশনে ১০০টি প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল। ওই সম্মেলনে জন ইতিহাসসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় ২০০ জন ইতিহাসবিদ, শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষার্থী ও পেশাজীবী বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। জন ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের সদস্য এবং এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ারস সেক্রেটারি মনিরা মাসরুরা ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী সাবিহা আফরিন বাধন সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন।-আমাদেরসময়