রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ
আমান উল্লাহ আমান-
মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মুহুর্মুহু গুলির শব্দে সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থেমে নেই। সোমবার ১৪১ জন রোহিঙ্গাসহ গত চার দিনে চার শতাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যদের টহল জোরদার থাকায় ঢালাও ভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ রয়েছে। তবে রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে শত শত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। গতকাল বাংলাদেশ-মিয়ানমার সংলগ্ন টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তে রাতের বেলায় আরকান রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিকান্ডে আগুনের লেলিহান শিখা সীমান্ত এলাকা থেকে দেখা যাচ্ছে। রাতে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ ভেসে আসছে। বিরোধপূর্ণ এলাকার সীমান্তে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা গেছে ও সেন্টমার্টিনের অদূরে জাহাজ যাতায়ত করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মিয়ানমার থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সাংবাদিকদের জানান, সামরিক হেলিকপ্টারটি মিয়ানমার উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় একটি ক্যাম্পে নামে। ঘণ্টা দেড়েক পর আবার চলে যায়। হেলিকপ্টারটি চলে যাওয়ার পর মিয়ানমার সেনারা নির্যাতন আরও বৃদ্ধি করেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানান, সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে মিয়ানমারের মেরুল্লা ও হাইসসুরাতা এলাকায় ব্যাপক আগুনের লেলিহান শিখা দেখা গেছে। বঙ্গোপসাগরে দেখা গেছে মিয়ানমার নৌ-বাহিনীর ৩টি জাহাজ। ফলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী বাসিন্দারা। বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সদস্যরা সীমান্তের স্থল ও নাফ নদের জলপথে অতিরিক্ত টহল জোরদার রেখেছে এবং সতর্ক পাহারায় রয়েছে। পাশাপাশি পুলিশও টহল জোরদার করেছে। সীমান্তের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে গত রবিবার বিজিবির মহাপরিচালক মেজর কর্নেল আবুল হোসেন ঘুমধুম এলাকার সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন। এসময় তিনি ‘বাংলাদেশের ভুখণ্ডে বিন্দু পরিমাণ ক্ষতি হলে তার সমুচিৎ জবাব দেওয়া হবে’ বলে জানান। অপরদিকে প্রাণ বাঁচাতে আরকান রাজ্যের রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। উখিয়ার ঘুমধুমের জলপাইতলী এলাকায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে। তাদেরকে বিজিবি অনুপ্রবেশে বাধা দিয়ে মিয়ানমারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এছাড়া টেকনাফ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকালে রোববার দিবাগত রাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত ১৪১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি ও পুলিশ। হোয়াইক্যং ও উনছিপ্রাং সীমান্ত এলাকা থেকে এসব রোহিঙ্গাদের আটক করা হয়। পরে স্ব স্ব সীমান্ত দিয়ে আটক রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত করেছেন ২ বিজিবি’র টেকনাফস্থ ব্যাটলিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম। এদিকে উখিয়া উপজেলার ঘুমধুম জলপাইতলীর জিরো পয়েন্টে অনুপ্রবেশের জন্য অবস্থানকারী রোহিঙ্গা ঢেকিবনিয়ার মোহাম্মদ হোছাইন, মিনারা বেগম, খুরশিদা বেগমসহ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত শুক্রবার থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরা পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করছে। মহিলাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। ঘরবাড়িসহ পুরো এলাকায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মোহাম্মদ হোছাইন আরো জানান, সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গুলি বর্ষণকালে প্রাণের ভয়ে পালানোর সময় তার পাঁচ বছরের ছেলেকে ফেলে চলে আসি। এখন ছেলেটি কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে আল্লাহই জানে। খুরশিদা বেগম জানান, তার স্বামীকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। চারমাসের একমাত্র শিশুপুত্রকে নিয়ে এলাকার অন্যান্যদের সাথে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে আসি। কিন্তু এখানেও বিজিবি বাধার মুখে রয়েছি। বর্তমানে অর্ধহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছি। তিনি আরো বলেন, একদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতন, অন্যদিকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। আমরা রোহিঙ্গাদের শেষ আশ্রয়স্থল কোথায়? তাদের সাথে কথার বলার সময় অন্যান্য রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরাও হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সবার চুখে মুখে আতংকভাব। রোদ বৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে সকলে জড়ো হয়ে কোন রকম ঠাঁই নিয়েছে। এসময় স্থানীয় কয়েকজন নারী পুরুষ তাদেরকে শুকনো খাবার বিতরণ করতে দেখা গেছে। টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, সীমান্তে দিন-রাত নিশ্ছিদ্র টহল জোরদার করা হয়েছে। কোনভাবেই মিয়ানমার নাগরিকরা যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে সর্তক নজরদারি রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে একযোগে ৩০টি চৌকিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জন সরকারি বাহিনীর সদস্য ও ৭৭ বিদ্রোহীসহ মোট ৮৯ জন নিহতের কথা জানায় মিয়ানমার স্টেট কাউন্সিল। এর জের ধরে বিদ্রোহীদের দমনে আরাকানে সেনা অভিযান জোরদার করে মিয়ানমার।