লুঙ্গি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শাহরিয়ার হোসেন’
লুঙ্গি পরে ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন শাহরিয়ার হোসেন।খাবারের দোকানে কাজ করা তরুণ, সিগারেট বিক্রেতারাও আজকাল লুঙ্গি পরেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সবাই প্যান্ট পরেন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান। ক্লাসও করেন লুঙ্গি পরে। ব্যতিক্রম এই শিক্ষার্থীর নাম শাহরিয়ার হোসেন ওরফে অনিক। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে এমএ পড়ছেন। মেহেরপুরের মুজিবনগরে তাঁর বাড়ি।মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কথা হয় শাহরিয়ারের সঙ্গে। খয়েরি চেকের লুঙ্গির সঙ্গে সাদা ফুলহাতা শার্ট। পায়ে স্যান্ডেল। একটু আগে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে উত্তরাধিকার পত্রিকাসহ বই কিনে ফিরেছেন। লুঙ্গির প্রসঙ্গ তুলতেই শাহরিয়ার বললেন, ‘গ্রামে সবাই পরে। শহরে বাসাবাড়িতে পরে। এই ঢাকা শহরে রাস্তাঘাটে বহু মানুষ লুঙ্গি পরে চলাচল করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পড়লে সমস্যা কি? শুনেছি, গুলশানে রিকশাচালকদেরও লুঙ্গি পরে ঢোকা নিষেধ। পোশাক দিয়ে কেন উঁচু-নিচু ভেদাভেদ করা হচ্ছে?’
লুঙ্গি পরে ক্লাসে যাওয়াকে শিক্ষক-সহপাঠীরা কীভাবে দেখেন? ‘প্রথম দিকে শিক্ষকেরা বিরক্ত হয়েছিলেন। সহপাঠীরা পাগলও ডাকতেন। এখন আর সমস্যা হচ্ছে না’—বললেন শাহরিয়ার। ক্যাম্পাসে শাহরিয়ারের বন্ধুর সংখ্যা একেবারে কম নয়। তবে তিনি আড্ডা দেন কম। বেশির ভাগ সময় বই পড়ে সময় কাটান। অবশ্য পাঠ্যবইয়ে আগ্রহ কম। শুধু নম্বর পাওয়ার জন্য পড়তে ভালো লাগে না তাঁর। পরীক্ষার ফলাফলও আহামরি নয়। তা নিয়ে আক্ষেপও নেই। এসব ‘পাগলামো’ বাড়িতে জানে? শাহরিয়ার লাজুক হাসেন; বলেন, লুঙ্গি পরে ক্লাস করার কথা জানে না। জানলে বাবা বকবেন না? ‘আপনি লিখলে বাবা পড়বেন, আর হেসে হেসে বকা দেবেন।’ বাবা শাহার আলী স্বাস্থ্য বিভাগের পরিদর্শক। মা আয়েশা সিদ্দিকা গৃহিণী। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে শাহরিয়ার বড়। জানালেন, বাবা তাঁর আসল বন্ধু। ছোটবেলা থেকে তিনিই সাহিত্যের বই কিনে দিতেন। প্রতিটি বইমেলার সময় কিছু টাকা আলাদা করে দিতেন বই কেনার জন্য।এবারের মেলার সময় বাবা কম টাকা দিয়েছেন জানিয়ে শাহরিয়ার বলেন, ‘মন খারাপ হয়েছিল। বাবাকে না জানিয়ে ১৫ হাজার টাকা ধার করে বই কিনে ফেলেছি। সেই টাকা এখনো শোধ করতে পারিনি। বাবা মাসখরচের যে টাকা দেন, তা থেকেও বই কিনে ফেলি। মাসের শেষের কটা দিন কষ্ট করে চলি।’
সাম্প্রতিক নানা বিষয় নিয়েও কথা বলেন শাহরিয়ার। তাঁর আক্ষেপ, উত্ত্যক্তের শিকার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে একজন বাবা আত্মহত্যা করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কত কিছু নিয়ে আন্দোলন করেন, এটা নিয়ে কিছু করলেন না। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবেন না শাহরিয়ার। দেশি মাছ ও মুরগির খামার করার ইচ্ছা। বাবাও বলেছেন, ‘চাকরি করতেই হবে, তা তো না।’ তারপর উদাস কণ্ঠ শাহরিয়ারের, ‘কত ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। দেশি ধানের জাতগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।’
শাহরিয়ারের বন্ধু তৌফিক আনজাম, আশিক, মাহমুদুল হাসান সিদ্দিকসহ অন্যরা তাঁকে মেধাবী বলেই মানলেন। তাঁর লুঙ্গি পরাকে পাগলামো নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসার উদাহরণ হিসেবেই দেখতে চান তাঁরা।আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তানজীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর জন্য যে মানসিক শক্তি দরকার, তা এই ছেলের আছে। এ কথাও ঠিক, ব্রিটিশ শাসকেরা যদি লুঙ্গি পরতেন, আমরাও লুঙ্গি পরতাম। এ ধরনের ব্যতিক্রমী চিন্তার মানুষ এখন কম। আমরাও এ ধরনের চিন্তার মানুষকে দূরে ঠেলে দিই। থাকুক না কিছু ব্যতিক্রম।