শরিকদের ৩০টির বেশি আসন ছাড়তে নারাজ আ.লীগ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় বাকি। কিন্তু তার আগেই নির্বাচন আয়োজন করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আগামী বছরের শুরুতে একাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে দলটি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দলটি সারা দেশে এককভাবেই তাদের নির্বাচনী প্রচার ও দল গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেছে। বসে নেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকরাও। তারাও আগামী নির্বাচনে শতাধিক আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রত্যাশায় কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টি আসন ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে শরিকদলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি শুরু হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী ও ১৪ দলের জোটের নেতা শেখ হাসিনা।
আসন ভাগাভাগির বিষয়ে এখো কৌশলী অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। যথাসময়ে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে দলটি। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, শরিক দলগুলো গত নির্বাচনে ৬০ আসন চেয়ে পেয়েছে মাত্র ১৮টি। এবার ১০০ আসনের প্রস্তুতি নিলেও তাদের কয়টি দেওয়া হবে তা জানার জন্য নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে নেতাদের এমন বক্তব্যে ধারণা করা হচ্ছে, আসন ভাগাভাগি নিয়েই জটিলতায় পড়বে আওয়ামী লীগ। তবে দলটির পক্ষ থেকে ২৫ থেকে ৩০ টি আসন ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।
উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন জোটের ৫ দলের ১৮ সংসদ সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ৭ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৬, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের ২, জাতীয় পার্টির (জেপি) ২ এবং ন্যাপের একজন সংসদ সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। আবার অনেকে নিজ নিজ দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছেন।
১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলো নিজ নিজ দলীয় কৌশলে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। ভোটের আগে জোটের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও অনানুষ্ঠানিকভাবে শরিক দলগুলোকে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও ১৪ দল জোটগতভাবে করবে। বিষয়টি ইতোমধ্যে জোটের শরিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসন বণ্টন নিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। নির্বাচনের বেশ সময় বাকি। ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতি নিতে জোটের শরিকদের বলেছি। জোটের পরিধি বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচনায় আছে। সবার সঙ্গে কথা বলেই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। একই বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ দল থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন। জোটের সর্বশেষ বৈঠকে এ বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।
সূত্র জানায়, দশম সংসদ নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টি ৫ আসন চেয়ে পেয়েছিল ৩টি। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে দলটি তিনটিতেই জয়লাভ করে। এ ছাড়া দলীয় প্রতীক হাতুড়ি নিয়ে নির্বাচন করে ১২ আসনের মধ্যে ৩ আসনে বিজয়ী হয় ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীরা। আগামী নির্বাচনে দলটি ২০ আসনে প্রার্থী দিতে চায়। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আগামী রোজার আগে ৩০ জেলায় জনসভা শেষ করার টার্গেট নিয়ে পার্টির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে জেলায় জেলায় জনসভা করা হচ্ছে। আগামীতে ২০ আসনে প্রার্থী দেব আমরা। জোটের সঙ্গে সমঝোতায় যে কয়টায় হয়, হবে। অন্যগুলো দলীয় প্রতীকে দেব।
এদিকে জাতীয় সম্মেলন কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ভাঙন দেখা দেওয়ার পর কিছুটা অপ্রস্তুত রয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। দশম সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, মাঈনুদ্দিন খান বাদল, শিরিন আক্তার নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলীয় প্রতীক মশাল নিয়ে নির্বাচনে লড়ে জয়ী হন নাজমুল হক প্রধান ও রেজাউল করিম তানসেন। এ ছাড়া নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হন নরসিংদী জেলার জাসদ নেতা জাহেদুল করিম। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের। দশম সংসদে ১৩ আসন চেয়ে ৭ পেয়েছিল জাসদ। কিন্তু এবার ভাঙনের পর জাসদের নেতারা আসন বণ্টন নিয়েও রয়েছেন ধোঁয়াশার মধ্যে। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না।
জাসদের একাংশের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়টি আমরা এখনো পর্যালোচনা পর্যায়ে রেখেছি। দলের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। একই বিষয়ে জাসদ অপরাংশের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, জনগণ তথা দলের নেতাকর্মী যাদের সঙ্গে রয়েছে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তারাই এগিয়ে থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। যাই হোক, নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
গত নির্বাচনে ত্বরিকত ফেডারেশন ৫ আসন চেয়ে ২ আসন পায়। দলটির চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম থেকে ও মহাসচিব লক্ষ্মীপুর থেকে নির্বাচিত হন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে কমপক্ষে ১০ আসন চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসটিব এমএ আউয়াল। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টি (জেপি) দশম সংসদ নির্বাচনে নিজ দলীয় প্রতীক বাইসাইকেল মার্কা নিয়ে ১৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটিতে জয়লাভ করে। তবে আগামী নির্বাচনে ৫০টিরও বেশি আসনে জেপির প্রার্থীরা মাঠে সক্রিয় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত নির্বাচনে বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় নির্বাচনী কৌশলের অংশ হিসেবে আমরা আমাদের দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছি। এবারও নির্বাচনের আগমুহূর্তে জোটের সঙ্গে আলোচনা করে কৌশল চূড়ান্ত করা হবে।
সাম্যবাদী দল দশম সংসদ নির্বাচনে ২ আসন চেয়ে একটিও পায়নি। তবে আগামী নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১, চুয়াডাঙ্গা-২, হবিগঞ্জের একটি এবং নাটোর অথবা নীলফামারী সদরের যে কোনো একটি আসন চাইবে দলটি। দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ূয়া এমনটিই জানিয়েছেন।
গত নির্বাচনে ৩ আসনে মনোনয়ন চেয়ে একটিও পায়নি ন্যাপ। পরে সংরক্ষিত আসনে ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা মোজাফফর আহমদের স্ত্রী আমেনা আহমেদকে সাংসদ করা হয়। তবে আগামী নির্বাচনে দলটির নেতারা ৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন।
দশম সংসদ নির্বাচনে প্রথমে ১১ জন, পরে মাত্র দুজনের মনোনয়ন চেয়ে একটি টিকিটও নিশ্চিত করতে পারেনি গণতন্ত্রী পার্টি। পরে পাবনা-৩ আসনে নিজ দলের প্রতীক কবুতর মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য খায়রুল আলম। কিন্তু তিনিও জয়ের মুখ দেখতে পাননি। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নূরুর রহমান সেলিম জানান, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১২ প্রার্থী রয়েছেন গণতন্ত্রী পার্টির। এ ছাড়া ১৪-দলীয় জোটের শরিক দল কিন্তু নিবন্ধন নেই এমন ৪ দল পরিস্থিতি বুঝে আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনের টিকিট চাইবে। দলগুলো হলো গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং বাসদ (রেজাউর রশিদ খান)।