শিববাড়িতে অভিযান দেখতে গিয়ে আহত ১, বিস্ফোরকের ফাঁদ! গুলি-বিস্ফোরণের শব্দ
দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় ‘আতিয়া মহল’- এ অভিযান দেখতে গিয়ে শিবলু মালাকার (২৭) নামের একব্যক্তি গুলিতে আহত হয়েছেন।তিনি স্থানীয় বসন্ত মালাকারের ছেলে। তাকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।স্থানীয়রা জানান, শনিবার (২৫ মার্চ) আহত শিবলু আতিয়া মহলের পাশের একটি মন্দির থেকে উঁকি দিয়ে অভিযান দেখছিলেন। এ সময় গুলিতে তিনি আহত হন। এদিকে, এখনও অভিযান চলছে।
এখনো থেমে থেমে গুলি-বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি পাঠানপাড়াস্থ জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে অভিযানরত সেনাবাহিনী সদস্যদের সঙ্গে জঙ্গিদের গুলি বিনিময় চলছে। একের পর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠছে দক্ষিণ সুরমা। এসব বিস্ফোরণ গ্রেনেডের বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরপর চারটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। জানা যাচ্ছে, বেলা সোয়া দুইটা দিকে আতিয়া মহলে বিকট শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। এর পর পরই এক সেনা সদস্যকে আহত অবস্থায় ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়। এর মিনিট দশেক পর আরেক সেনা সদস্যকে আহত অবস্থায় বের করে নিয়ে আসেন মেডিকেল কোরের সদস্যরা। এরআগে, আতিয়া মহলে অবরুদ্ধ বাসিন্দাদের উদ্ধারের জন্য ১১.৪৫ মিনিটে ‘জঙ্গিদের’ ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন সেনাবাহিনী। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সিলেট দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকার ‘আতিয়া মহলে’ সেনা বাহিনীর প্যারা কমান্ডোর ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’-এ এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৫ জন সদস্যকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে জকিগঞ্জ থানার এএসআই মুহিবুর রহমানের পরিবারসহ ১২টি পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন।
শনিবার সকাল ৯.৫০ মিনিটে থেকে বেলা ১১.২৪ মিনিট পর্যন্ত তাদের উদ্ধার করা হয়। ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারুল মোমেন অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জানা গেছে, অভিযান শুরুর পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চার ও পাঁচতলা থেকে প্রথমে ছয়টি, পরে পৌনে ১১টার দিকে তৃতীয় ও দ্বিতীয়তলা থেকে আরো ছয়টি পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন। উদ্ধারের পর নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি জানান, পুলিশ কর্মকর্তা মুহিবুর রহমানের পরিবারসহ অন্তত ১২টি পরিবারের সদস্যদের সেনা প্যারা কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। এদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছেন। পরে তাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, ভবনে থাকাকালীন তাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বর্তমানে প্যারা কমান্ডোরা জঙ্গিদের ফ্ল্যাটটি ঘিরে রেখেছে। ভবন থেকে বাকিদেরও নিরাপদে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। আতিয়া মহলে ২০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৭টি ফ্ল্যাট ভাড়া ছিল। এর মধ্যে নিচতলার একটি ফ্ল্যাট মর্জিনা ও কাউসার স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে ভাড়া নেয়। ঝড়ের সময় ওই এলাকার আশপাশ কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার হয়ে যায়। এ সময় সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে আশপাশের বাড়িতে টর্চলাইট খুঁজতে দেখা যায়।
সাড়ে ৮টার পর অভিযান শুরুর সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কে সকাল থেকে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে সকাল থেকে সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে দেখা যায়।হয়েছে বলে জানা গেছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রোকন উদ্দীর এ ব্যাপারে জানান, এই মুহূর্তে আতিয়া মহল সেনা কমান্ডোদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা অভিযান শুরু করেছেন। জঙ্গিরা পুলিশের আহ্বানের পরও আত্মসমর্পণে সাড়া না দেওয়ায় সোয়াট টিমের সঙ্গে অভিযানে যোগ দেয় সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ইউনিট। অভিযান শুরুর আগে সেখানে আনা হয় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পুলিশের সাঁজোয়া যান ও কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স। বাড়িটি ঘিরে রাখার দীর্ঘ ৩০ ঘন্টারও বেশি সময় পর শনিবার সকাল ৮.২৮ মিনিটে ওই ভবনে এ অভিযান শুরু হয়। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) জেদান আল মুসা। সকাল ৭টার পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা শুরু করে। পরে মাইকিং করে স্থানীয় অধিবাসী এবং উপস্থিত জনসাধারণকে অন্তত কিলোমিটার দূরে চলে যাওয়ার দিচ্ছে পুলিশ। সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদেরও এই দুরত্বে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে অভিযান শুরু হওয়ার আগে থেকে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কে সকাল থেকে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। যান চলাচল বন্ধ থাকায় সকাল থেকে সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে দেখা যায়। ওই ভবনে আটকা পড়া ২৯টি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগ আর আতঙ্কে রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাইরে থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। ভোরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা দেখা গেছে, সোয়াত টিম ও সেনাবাহিনীর দলসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা খুবই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ওই ভবনের আশপাশে কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। ওই বাড়ির আশপাশের রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার বিকাল ৪টার কিছু আগে ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় সোয়াত ফোর্স। এর কিছুক্ষণ পর বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটও আসে ঘটনাস্থলে। রাত পৌনে ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে আসে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিটের একটি দল। রাতে সার্চ লাইট দিয়ে আলোকিত করে রাখা হয় পুরো আতিয়া মহল। বাড়ানো হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা। এছাড়া সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের চিকিৎসকদের রাখা হয় প্রস্তুত। তবে ‘জঙ্গিদের’ ফ্ল্যাটে চূড়ান্ত অভিযান আর হয়নি। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে আতিয়া মহল ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাঁচতলা ওই ভবনের নীচতলার একটি ফ্ল্যাটে নারীসহ একাধিক ‘জঙ্গি’ রয়েছে বলে ধারণা পুলিশের। ওই ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে নারী ও পুরুষ ‘জঙ্গি’ শুক্রবার দুপুরের পর দ্রুত সোয়াত ফোর্স পাঠাতে বলেছিল। তারা বলেছিল, ‘তোমরা (পুলিশ) শয়তানের পথে, আমরা আল্লাহর পথে। দেরি কেন, দ্রুত সোয়াত ফোর্স পাঠাও।
আতিয়া মহলের চারিদিকে বিস্ফোরকের ফাঁদ!
সিলেট শহরের যে বাড়িতে জঙ্গিদের ধরতে সেনাবাহিনীর অভিযান চলছে, সেই বাড়িটি বিস্ফোরক পেতে ভরে রাখা হয়েছে বলে আশংকার করছেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা।আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ দফতরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল রাশিদুল হাসান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এ কারণেই এই অভিযান শেষ হতে এত বেশি সময় লাগছে। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার পাঁচতলা ভবনটি দুদিন ধরে ঘিরে রাখার পর শনিবার সকালে সেখানে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান শুরু হয়। প্যারা-কমান্ডোদের একটি দল সকাল সাতটার দিকে ‘আতিয়া মহল’ নামে ওই পাঁচতলা ভবনটিতে সশস্ত্র অভিযান চালায়।
লেফটেন্যান্ট কর্ণেল রাশিদুল হাসান জানান, পাঁচ তলা ভবনটি থেকে তারা এ পর্যন্ত ৭৮ জন মানুষকে নিরাপদে বের করে এনেছেন। এখন ভেতরে জঙ্গি ছাড়া আর কেউ নেই বলে তাঁরা ধারণা করছেন। তিনি বলেন, জঙ্গিদের সংখ্যা ৫-৬ জন হবে বলে তারা অনুমান করছেন। তাদের আত্মসমর্পনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে ভেতরে তারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এই বিস্ফোরণের শব্দ বাইরে থেকেও শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন ঘটনাস্থলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদকিরা। সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে অবস্থানরত স্থানীয় সাংবাদিক শাকির হোসেন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সিলেটে এখন তুমুল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যেই তারা বাড়িটির ভেতর থেকে আসা গুলিবর্ষণের শব্দ পাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর এই অভিযানটির নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’।
জানা যাচ্ছে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় চিরুনি অভিযান শুরু করে কয়েকশ পুলিশ। এলাকাটি সিলেট শহরের ভেতরেই। জিরো পয়েন্ট থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে এই শিববাড়ির অবস্থান। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যের দিকে তাদের অভিযান ঘনীভূত হয় দুটি বাড়িকে ঘিরে। দুটি বাড়ির মালিকই একই ব্যক্তি। তিনি অবশ্য আরো দূরের অন্য একটি বাড়িতে থাকেন। তার কাছ থেকে সংগ্রহ করা ভাড়াটিয়াদের জাতীয় পরিচয়পত্র বিশ্লেষণ করে পুলিশ ধারণা করে ‘আতিয়া মহল’ নামের পাঁচ তলা বাড়িটিতে মর্জিনা নামে এক মহিলার ভাড়া নেয়া ফ্ল্যাটটিই সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা। জাতীয় পরিচয়পত্রে মর্জিনার স্বামীর নাম মুসা বলে উল্লেখ আছে। বৃহস্পতিবার সারা রাত এবং শুক্রবার সারা দিন ও রাত বাড়িটিকে ঘেরাও করে রাখলেও ভেতরে কোন অভিযান চালায়নি পুলিশ। অবশেষে শনিবার সকাল থেকে বাড়িটিতে অভিযান শুরু করল সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসের প্যারা-কমান্ডো দল।