শিশুরা আপনার ব্যর্থতার ‘ঢাল’ নয়
এদিকে শিশুদের এই বহুমাত্রিক ঝুঁকির মধ্যে রেখে সরকার প্রাথমিকভাবে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও যে মন্ত্রীকে নিয়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো তাকে সরানো হলো না। আমরা তার অবস্থান পরিবর্তন হতে দেখলাম যদিও। ক্ষমা চাইলেন, গেলেন নিহত ছাত্রছাত্রীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে, আহত শিক্ষার্থীদেরও তিনি দেখতে গেলেন। কিন্তু তার অতীত কার্যকলাপ থেকে অর্জিত শিক্ষা তাকে বিশ্বাস করার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সরকার বাধ্য হয়ে হোক কিংবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই হোক না কেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে, সেটা লক্ষমান। ইতোমধ্যেই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সর্বত্র বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, তার মধ্যে ফাঁক খুঁজে পাওয়া গেলে সরকারকে আবারও চাপ দেওয়ার সুযোগও থাকছে। কিন্তু আমরা এখনও শিশুদের রাস্তায় রেখে তাদের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক অপ্রাপ্তি মেটাতে চাইছি। যে ড্রাইভার পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে হোক, সড়কে অব্যবস্থাপনার কারণে হোক কিংবা হোক ইচ্ছাকৃত খুন – যে কারণেই হোক না কেন সড়কে মানুষ হত্যার মতো ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটায়, তাদের সঙ্গে এই যে যারা শিশু-কিশোরদের রাস্তায় রেখে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করতে চাইছেন তাদের বিশেষ কোনও পার্থক্য আছে বলে মনে করার কারণ আছে কি? নেই। ওই ড্রাইভার আর এই শিশু-কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে উস্কানিদাতাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। একদল সরাসরি হত্যা করছে আরেক দল জেনে-শুনে-বুঝে শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। এই নিষ্ঠুরতা তাহলে আমাদের জাতিগত সমস্যা, কী বলেন?
লক্ষণীয় যে, শিশু-কিশোররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাইসেন্স পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছে এদেশের ক্ষমতাবান, ক্ষমতাহীন, রক্ষক-ভক্ষক সকল শ্রেণি-পেশার মানুষই আইন ভঙ্গ করেন। এই প্রমাণ আমাদের জাতীয় লজ্জা তৈরি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তার মানে একথাটিও সত্য যে নিরাপদ সড়ক কেবল দাবির বিষয় নয়, সকল পক্ষের, সকল ব্যক্তির জন্যও অবশ্য পালনীয় একটি ‘প্র্যাকটিস’। আর সবচেয়ে বড় ও গুরুদায়িত্বটি আসলে সরকারের। আজকে হয়তো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে, কালকে অন্য যেকোনও সরকারই ক্ষমতায় আসতে পারে। এসেছেও অতীতে। সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ করা যায়নি, কারণ সড়ককে কেন্দ্র করে প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব স্বার্থ। সেই স্বার্থ সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে নিশ্চিত করা হয়, সেটাও আমরা জানি। আজকে আমরা পদত্যাগ চাইছি শাজাহান খানের। কালকে আমাদের চাইতে হতে পারে শিমুল বিশ্বাসের। কারণ, দুজনেই এদেশের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জানা যায়। এই সত্য শিশু-কিশোররা জানে না, তারা রাস্তায় নেমে দেখলো যে পদত্যাগ চাইছে যাদের তারা তো আছেই সড়কে মৃত্যু নিয়ে ‘হাসবার’ জন্য, কিন্তু সড়কে এমন মানুষও আছে যারা আইনের তোয়াক্কা করে না, উল্টোদিক থেকে গাড়ি চালায় কিংবা চালকের সঠিক লাইসেন্স আছে কিনা তাও দেখে না। এই যে দীর্ঘ সারিবদ্ধ অনিয়ম, তা কি শিশু-কিশোরদের দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব? যদি কেউ সে স্বপ্ন দেখে থাকেন তাহলে বলতেই হবে, আমাদের দুর্ভাগ্য শেষ হওয়ার নয়। আমরা নিজেদের ব্যর্থতাকে, অপ্রাপ্তিকে শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবকার করে তার প্রতিকার চাইছি। এটা কেবল অন্যায় নয়, এটা গর্হিত অপরাধ।
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, একদল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষও এই শিশুদের রাস্তায় রেখে তাদের ‘দাবি’ আদায় করার জন্য নিয়মিতভাবে উস্কানি দিয়ে চলেছেন। দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে থেকে তারা কেবলই বলে চলেছেন এক কথা, তোমরা রাস্তায় থাকো, রাস্তা ছেড়ো না। কী ভয়ঙ্কর আবেদন। একসময় তারা রাজনীতি করেছেন এদেশে। রাস্তার রাজনীতি। তাতে তারা জনগণের উপকার করেছেন কতটুকু সেটা বোঝা যায় না, কিন্তু তারা নিশ্চিত উপকার করেছেন সামরিক শাসকদের এবং পরে তারা বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর লেজুড়বৃত্তি করেছেন সম্মিলিতভাবে। এতে যে সমাজ/রাষ্ট্রের বিরাট কোনও উপকার হয়নি সেটা শিশু-কিশোররা আজকে আন্দোলন করে প্রমাণ করেছে। কিন্তু সেসব ব্যর্থজনেরা নিষ্ঠুরের মতো এই ছাত্রছাত্রীদের ক্রমাগত উস্কে চলেছেন। ভাবছেন, যদি এর ফলে তাদের ‘কোটারি স্বপ্ন’ কিছুটা হলেও অর্জিত হয়? একবারও তারা ভাবছেন না, তাদের ব্যর্থতার ঢাল কেন হবে শিশুরা? কথায় কথায় তারা তুলনা করেন পশ্চিমের সঙ্গে বাংলাদেশকে কিন্তু পশ্চিমে শিশুদের রাস্তায় নামানোর আগে যে বহু কিছু ভাবতে হয়, বাংলাদেশের শিশুদের ক্ষেত্রে সে ভাবনাটি তারা ভাববেন না। কারণ, এই শিশুরা তো বাংলাদেশের শিশু, তাদের কি আর নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে? আগেই বলেছি, সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে এই শিশুরা যা করে দেখিয়েছে তা কেবল অভাবনীয়ই নয়, ইতিহাসেও বিরল।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ বহুমুখী দুঃসময় পার করে। তার মধ্যে অপশাসন, দুঃশাসন নিঃসন্দেহে অন্যতম। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হলো, দেশপ্রেমের অভাব ও কেবল নিজের জীবনকে নিরাপদ রাখার মতো স্বার্থপরতাও আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ হয়ে গেছে। ফলে একটি সংঘাতময় সমাজব্যবস্থার ভেতর আমাদের বসবাস। ঢাকা শহরকে অচল করেছে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা, অপরদিকে সারা দেশকে অচল করে দিচ্ছে পরিবহন শ্রমিকরা। একপক্ষ চাইছে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে, নিরাপদ সড়কের দাবি জানাচ্ছে। আরেক পক্ষ নিজেদের ‘জীবিকা’ বাঁচাতে চাইছে। এই ভয়ঙ্কর ও উত্তাল সময়ে শেষোক্ত পক্ষের কথা কেউ শুনছি না আমরা। হয়তো পরিস্থিতি শান্ত করলে তাদের কথাও শুনতে হবে আমাদের। কিন্তু এর ফলে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে ঘি ঢেলে একেক পক্ষ একেক রকমভাবে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। আর এই অচলাবস্থার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে পড়ছে আন্দোলনত শিশুরা। প্রথম দু’তিন দিন রাস্তায় লাইসেন্স চেক করতে এলে সকলেই এগিয়ে দিচ্ছে কিন্তু এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওচিত্র বা অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, শিশুদের সঙ্গে তারা বিতর্ক শুরু করছে। এই বিতণ্ডা সংঘাতে রূপ নিতে যে সময় লাগবে না সেটা শুরুতেই অনেকে বলেছেন। কারণ, অন্যের ‘বাচ্চা’র নিরাপত্তা নিয়ে ভাববার মতো জাতীয়-মানসিকতা এদেশে তৈরি হলে তো সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যেতো, এদেশে আর সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে কোনও শিশু-কিশোরকেই রাস্তায় নামতে হতো না, তাই না? মোটরসাইকেল আরোহী যখন বাসের ধাক্কায় মারা যায় তখন দোষ বাসচালকের, কিন্তু ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালানোর সময় পথচারীকে ধাক্কা দেওয়ার দোষ মোটরসাইকেল আরোহী কখনোই নিতে চায় না- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই সেটি নিশ্চিত করা যায়। মোটরসাইকেল আরোহী নিজে যখন অপরাধ করেন তখন সেটিকে তিনি অপরাধ মনে করেন না, কিন্তু যখন বাস তাকে ধাক্কা দেয় তখন অপরাধ বাসচালকের। আসল কথা হলো, সমস্যাটি বহুপাক্ষিক, বহুমাত্রিক এবং সর্বোপরি কঠোর নিয়ম, আইন ও আইনের শাসনের। এক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার শেষতো নেই-ই, আছে সীমাহীন অপরাধও, ব্যক্তি ও সামষ্টির। সুতরাং, কোনোভাবেই তার সমাধান শিশুরা দিতে পারবে না, তাদের সে কারণে রাস্তায় রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও কোনও মানে নেই তাই।
শুরু করেছিলাম ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা দিয়ে। ভদ্রলোককে ক্লান্ত লাগে আজকাল দেখতে। কারণ, তিনি তো আসলে আমাদের সমর্থন বা সহযোগিতা কোনোটিই পাননি, তাই না? আজকে ছাত্রছাত্রীরা তার দাবিটি নিয়েই রাস্তায় নেমেছে। এখন তাদের নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে তাদের দাবি নিয়ে আপনি/আমিই প্রতিবাদী থাকি, সরকারকে বাধ্য করি শিশুদের দাবিগুলো পূরণ করতে আর নিজেদের নাগরিক/সামাজিক/নিরাপত্তার দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করি। কেবল নিজেদের/পরিবারের নিরাপত্তা নয়, অন্যের জীবন বিপন্ন করে নিজের জীবন রক্ষা নয়, অন্যের ভাত কেড়ে নিয়ে নিজের পরিবারের ভাত জোগানো নয়- আপনি-আমি-তিনি মিলেই এই সমাজ ও রাষ্ট্র, একে নির্মাণের দায় কারো চেয়ে কারোরই কম নয়। এসব দায় ও দায়িত্ব শিশুদের রাস্তায় রেখে আপনি পালন করতে চাইলে দুদিন পর এই শিশুরাও আপনার/আমার মতোই স্বার্থপর হয়ে উঠবে- সেই সত্যও কি অস্বীকার করা যাবে? শিশুরা তো দেখেই শেখে, নাকি?
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি