সম্ভাবনার দেশে এগিয়ে যাওয়া প্রবাসীরা
নিউইয়র্কে আইন পেশায় পরিচিত নাম অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী। রাজ্যের ডেমোক্র্যাট দলের ডিস্ট্রিক্ট লিডার অ্যাট লার্জও তিনি। মঈন চৌধুরী প্রথম আলোকে বললেন, ‘একজন বাংলাদেশি হিসেবে স্বদেশিদের নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘সম্ভাবনার এ দেশে আমাদের ক্রমেই উত্তরণ ঘটছে যোগ্যতার সঙ্গে।’ নিউইয়র্কের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা লং আইল্যান্ড সিটি থেকে এবার রাজ্য অ্যাসেমব্লির পদে লড়ছেন মেরি জোবাইদা। এই এলাকায় ৩৫ বছর থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত একজনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এই প্রবাসী বাংলাদেশি। এর আগে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সিনেটে নির্বাচিত হয়েছেন শেখ রহমান। নিউইয়র্কে মুর্শেদ আলম, শেখ হেলালসহ অনেকেই আমেরিকার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। সর্বত্রই বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাছে উচ্চারিত হচ্ছে এসব নাম।
উচ্চারিত হচ্ছে নিনা আহমেদের নাম। নিনা আহমেদ সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফিলাডেলফিয়া নগরীর ডেপুটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মিশিগানে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন সুমিন আহমেদ। সেই অগ্রযাত্রা চলমান। হ্যামট্রামিক সিটিতে বাংলাদেশিরা সিটি কাউন্সিল নিয়ন্ত্রণ করছেন। আমেরিকার রাজনীতির বাইরেও অন্যান্য পেশায় সুনাম অর্জন করছেন বাংলাদেশিরা। সমাজসেবার জন্য এলিস আইল্যান্ড পদকের মতো সম্মানজনক আমেরিকান পদক পেয়ে বাংলাদেশিদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ।
নিউইয়র্ক পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি কাজ করছেন। বিশ্বের ব্যস্ততম নগরী নিউইয়র্কে নিয়মিত টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশি চৌকস পুলিশ কর্মকর্তারা। বিশ্বের অন্যতম সেরা পুলিশ বাহিনী নিউইয়র্ক পুলিশের উচ্চপদে অভিষেক ঘটেছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহর। ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহ একজন বাংলাদেশি আমেরিকান হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। এনওয়াইপিডির পুলিশ কর্মকর্তা রাজুব ভৌমিক বলেন, ‘আমেরিকা সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। আমাদের বাংলাদেশিদের এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পালা।’
নিউইয়র্ক সিটিতে গত দুই দশক থেকে ক্যাব চালান সুবল উদ্দিন। দেশে স্বজনদের দেখভাল করেন, অর্থ পাঠান নিয়মিত। নিজের সন্তান নিউইয়র্কের অন্যতম সেরা কলেজ থেকে পাস করে ডাক্তার হতে চলেছেন। সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হন সুবল। কখনো আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে তাঁর। বললেন, কাজ আর কাজ এ দেশে তাঁর যৌবনের সেই দিনগুলো কেড়ে নিয়েছে। তারপরেও সন্তানের সাফল্য তিনি উৎফুল্ল। তাঁর আশা, বিশ্বের সেরা দেশ থেকে ডাক্তার হয়ে ছেলে তাঁর মানবতার হয়ে কাজ করবেন। দাপটের সঙ্গে গ্রোসারি ব্যবসা করেন সুহেল আহমেদ। জানালেন বাংলাদেশি গ্রোসারি দোকানে বাংলাদেশি পণ্য প্রাধান্য পায়। দেশ থেকে ৪০ বছর আগে আসা নিউইয়র্কের এই প্রবাসী ব্যবসায়ী বলেন, ‘নিজের দোকানে যখন বাংলাদেশি পণ্য বিক্রি করি তখন মনে করি দেশকেই সেবা দিচ্ছি।’
স্কুল–কলেজে ভালো করছে বাংলাদেশিরা। নিউইয়র্কের সেরা সব স্কুলে ভর্তিতে এগিয়ে আছে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশিরা। তরুণ চিকিৎসক অপু চৌধুরী আমেরিকায় দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশি। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, ‘আমার বাবা ক্যাব চালিয়েছেন জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়। অপু বলেন, বাবা মারা গেছেন, আমি ডাক্তার হয়েছি। এক দিনের জন্যও ভুলি না আমার উৎসের কথা।’ উবার চালান তাজুল আহমেদ। জানালেন, তাঁর ছেলে হার্ভার্ড, ইয়েল, প্রিন্সটনসহ সেরা আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আমন্ত্রণ পেয়েছে। শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের প্রভাবশালী লোকজনের মেধাবী সন্তানেরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন দেখেন। তাজুল গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘আমার সন্তান আইনস্টাইনের স্মৃতিধন্য প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে যাবে বলেই ঠিক করেছে।’
আমেরিকার মধ্যে নিউইয়র্কেই বাংলাদেশিদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশিদের ব্যাপক অভিবাসন ঘটে আমেরিকায়। ঠিক কত সংখ্যক বাংলাদেশি নিউইয়র্কে আছেন তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। রাজ্যের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের এক-তৃতীয়াংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। আর ৬০ শতাংশ অভিবাসীর ইংরেজি বলার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব আছে। নিউইয়র্কে গড়ে যেকোনো বাড়িতে ২ দশমিক ৬ লোক বাস করে থাকে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রতি ঘরে গড়ে ৪ দশমিক ২। নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি অভিবাসীর জন্ম বাংলাদেশে। স্থানীয় বাঙালি কমিউনিটির নেতৃস্থানীয়রা মনে করেন, ভাষাসহ কিছু প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারলে অসচ্ছল প্রবাসীরা অনেকটাই সচ্ছল হতে পারেন। পাশাপাশি সমাজের মূল স্রোতেও তাঁরা মিশে যেতে পারেন সহজে।