সময় এসেছে সব নারীকে একই দিনে হাটার
গর্ভপাত-বিরোধের বিরুদ্ধে। সমকামী-রূপান্তরকামীদের বিরুদ্ধে যে বৈষম্য— তার বিরুদ্ধে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। মনে আছে সেই যে বিলি বুশের সঙ্গে বসে মেয়েদের সম্পর্কে অত্যন্ত কুৎসিত কথাগুলো বলেছিলেন। টেপটা ফাঁস না হয়ে গেলে আমরা জানতে পারতাম না ট্রাম্পের আসল চরিত্র। অবশ্য কয়েকজন মেয়ে এর মধ্যেই জবানবন্দি দিয়ে গেছেন, বর্ণনা করেছেন কী করে ট্রাম্প তাঁদের যৌন হেনস্থা করেছিলেন। যার যা নিয়ে ক্ষোভ, সব নিয়ে পথে নেমেছে।
পুরুষেরা যখন অন্যায় করে, সমাজকে নষ্ট করে, রাজনীতিকে ভ্রষ্ট করে, দৃষ্টিকে কলুষিত করে, নারীকে বন্দী করে তখন মানবসভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য নারীকেই হাল ধরতে হয়। পুরুষেরা বৈষম্যের সমাজ তৈরি করেছে, মেয়েদের নিম্নলিঙ্গ হিসেবে অপদস্থ, অপমান আর অত্যাচার করার রীতি তৈরি করেছে। সেই সমাজ এবং তার রীতি বারবারই ভেঙেছে নারী। পুরুষেরা ভোটের নিয়ম তৈরি করেছে ভোটের অধিকার নারীকে না দিয়ে। নারীরা ভোটের অধিকার পাওয়ার জন্য পথে নেমেছে।
সেই থেকে নারীরা পথে। ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ আলাদা করার সংগ্রামে নারী ছিল, ধর্মের ভিত্তিতে নয় বরং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরি করার আন্দোলনে নারী ছিল। নারী যতবার নির্যাতিত হয়েছে পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র দ্বারা, ততবারই পথে পথে গর্জে উঠেছে। লড়াই করেছে বলে ইউরোপ আর আমেরিকার নারীরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি অধিকার ভোগ করে।
কিন্তু এশিয়া আর আফ্রিকার মেয়েরা কী করছে? সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত তো তারাই। সবচেয়ে ভয়াবহ পুরুষতন্ত্র তো এই দুই মহাদেশেই। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদিতা, নারী বিরোধিতা, নারী বিদ্বেষী সংস্কার-কুসংস্কার, রীতি-নীতি তো এই দুই মহাদেশেই। নারীরা কোথায় যখন পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় অভূতপূর্ব নারী জাগরণ ঘটছে?
এশিয়া আফ্রিকার রাস্তায় মেয়েরা একেবারেই যে পথে নামেনি তা নয়। নেমেছে, তবে অনেক মেয়েই তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে নামাতে মিশরের তাহরির স্কোয়ারের জনজোয়ারে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে কালিমা লেপে দেওয়া হলো, যখন একের পর এক মেয়েদের যৌন হেনস্থা করতে লাগলো পুরুষেরা। বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখের ভিড়ে মেয়েদের যৌন নিগ্রহ করে পুরুষেরা।
ভারতে মেয়েরা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে ‘স্লাট ওয়াক’-এ গিয়েছিল একবার, না ছোট পোশাক কেউ পরেনি, তাতেও কটাক্ষের শেষ নেই পুরুষদের। প্রচুর পুলিশ ছিল স্লাট ওয়াকে হামলা হলে মেয়েদের রক্ষা করার জন্য। মেয়েরা কেন নিজেদের সমস্যা দূর করার জন্য আন্দোলন করে না? একবারই শুধু দেখেছি ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিশাল জমায়েত মেয়েদের। দিল্লির বাসে বর্বর গণধর্ষণের ফলে একটি মেয়ের মৃত্যু হয়েছিল। এভাবে মৃত্যু যেন আর কারোর না হয়। জমায়েতের উদ্দেশ্য ছিল সেটিই। পুলিশ লাঠি চার্জ করে জমায়েত ভেঙেছিল।
এই জমায়েতের কারণে আইন হয়তো বদলেছে, সমাজ বদলায়নি। আগেও যেমন বাসে বা ট্রেনে মেয়েরা ধর্ষিতা হতো, এখনও হয়। আগে যেমন মেয়েদের যৌনাঙ্গে পুরুষাঙ্গ ছাড়াও বোমা, বোতল, ছাতা, লাঠি, লোহা লস্কর ইত্যাদি ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হতো, এখনও তাই হয়। শুধু কিছু ভালো ভালো আইন বানিয়ে যদি সমাজ বদলানো যেত, তাহলে অনেক সমাজই অনেক আগেই বদলে যেত। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে, আইন তো সেই কতকাল থেকেই সমানাধিকারের ভিত্তিতে, তবে আজও কেন তাদের পথে নামতে হয় সমানাধিকারের জন্য? প্রাচ্যের মেয়েরাই বা আর কতকাল ঘুমিয়ে থাকবে? আর কতকাল তারা অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে রয়ে যাবে?
এমন নয় যে প্রাচ্যের মেয়েরা শিক্ষার আলো একেবারেই পায়নি। এমন নয় যে প্রাচ্যের মেয়েরা কেউই স্বনির্ভর নয়। তবে বাধাটা কোথায়? আমার মনে হয় বাধাটা আমরা দেখতে অভ্যস্ত। প্রাচ্যের মেয়েরা আন্দোলন করে কিছু আদায় করেনি। যে অধিকারই তারা পেয়েছে, সে অধিকার তাদের দান করা হয়েছে বলে পেয়েছে। লড়াই করে প্রায় কিছুই আদায় করেনি। সংসদে আজও তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত। আজও যখন রাস্তায় বেরোই, দেখি মেয়েদের সংখ্যা লজ্জাজনকভাবে কম। বাহির মেয়েদের জন্য নয়, মেয়েদের জন্য ঘর, মেয়েদের জন্য চার দেওয়াল। যে শিক্ষা মেয়েরা পেয়েছে, তা একাডেমিক শিক্ষা, শুধু চাকরি বাকরি করে কিছু টাকা পয়সা বাবার ঘরে বা স্বামীর ঘরে আনার জন্য।
সমানাধিকারের শিক্ষা পায়নি, পেয়েছে পুরুষ কর্তা-নারী দাসি এই বৈষম্য মেনে নেওয়ার শিক্ষা, লড়াই করার শিক্ষা পায়নি, পেয়েছে আপস করার শিক্ষা। হাজার বছর আগে নারীকে যেমন যৌন বস্তু ছাড়া আর কিছু হিসেবে ভাবা হতো না, এখনও ঠিক তাই। সময় বদলেছে, সমাজ বদলায়নি। যে সমাজে বৈষম্যকে দূর দূর করে তাড়ানো হয় না, বরং সমাদর করা হয়, সে সমাজ সহজে বদলায় না।
কিন্তু কঠিনকে জয় করার বাসনা কেন মানুষের থাকবে না? মেয়েরা কি সবাই এক যোগে বোবা হয়ে গেল, পঙ্গু হয়ে গেল, অন্ধ হয়ে গেল? কাউকেই তো দেখি না রুখে দাঁড়াতে? মৌলবাদের বিরুদ্ধে যত না পুরুষ দাঁড়াবে, তার চেয়ে বেশি তো দাঁড়ানোর কথা মেয়েদের। কারণ মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু মৌলবাদীরা । পাশ্চাত্যের সবকিছুই তো মেয়েরা পাচ্ছে। খবরাখবর, সিনেমা থিয়েটার, নাচ গান, বই পত্র, ফ্যাশন ডিজাইন, মোবাইল, টেকনোলজি- কী নয়? গোটা পৃথিবীই এখন প্রায় সবার হাতের মুঠোয়। তবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উৎসাহটি কেন পশ্চিম থেকে পূবের দিকে আসে না? লড়াই করে জিতে নেওয়ার উদ্দিপনাটি ঠিক জায়গামতো পৌঁছয় না কেন?
ট্রাম্পই কি কেবল নারী বিরোধী? এরকম নারী বিরোধীরা এশিয়া আর আফ্রিকার সমাজ, আর রাষ্ট্র চালাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কেন পথে নামে না নারীরা? দেখেও কেন শেখে না তারা? অন্তঃপুরবাসিনীদের সময় হয়েছে অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে বিশ্বের নারীর সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটার। সময় হয়েছে সমতার তাগিদে নিউইয়র্কে, নতুন দিল্লিতে, নোয়াখালীতে, নিউক্যাসেলে মেয়েরা একই দিনে হাঁটার। মাথা উঁচু করে হাঁটার। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচায় নারীই। প্রাচ্যের নারীর কেন সেই দায় থাকবে না?
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন