সাঈদীর ‘চন্দ্র বিজয়’ ও চলমান কোটা আন্দোলন
জুয়েল রাজ- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে শুরু থেকেই চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলন এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। ব্যক্তিগত ভাবে , কোটা নিয়ে মাথা ব্যথা নাই। কারণ আমি মেধাবী না এবং কোটার আওতার বাইরে। ২০০৪ সালের মাস্টার্স রেজাল্ট হয়েছিল ২০০৭ সালে। সেই চারদলীয় জোটের স্বর্ণযুগে! চাকরীর বাজারের কথা আর নাই বা বলি। যেহেতু চাকরী পাই নাই সেহেতু আমি মেধাবী ছিলাম না ধরেই বলছি। যারা আন্দোলন করছেন, তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এখনো পড়ালেখা শেষ করেন নি কেউই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেয়ার পরও আন্দোলন চলমান। মনে হচ্ছে উনারা আগামীকালকেই চাকরীতে যোগ দিবেন। অথবা কোটার কারণে চাকরী থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে, জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। অন্যদিকে তার দলের নেতৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করছেন। প্ল্যাকার্ডের মেধাবী! শ্লোগান গুলো আমার মতো অনেকেই দেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস বয়ান করছেন। কিন্তু একবার কি ভেবেছেন ৬২ থেকে ৭১ কিংবা ৯০ এর কোন আন্দোলনে এমন অশ্লীল প্ল্যাকার্ড বা শ্লোগান কি কেউ দেখেছেন? ধরে নিলাম আন্দোলন কারীদের কোটা প্রথা বাতিলের দাবী যৌক্তিক। কোটা সংস্কারের দাবিগুলো কী?’বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদ’এর ব্যানারে যে পাঁচটি বিষয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছে সেগুলো হল –
- কোটা-ব্যবস্থা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা (আন্দোলনকারীরা বলছেন ৫৬% কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ। সেটিকে ১০% এ নামিয়ে আনতে হবে)।
- কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া।
- সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা (মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে চাকরীর বয়স-সীমা ৩২ কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০। সেখানে অভিন্ন বয়স-সীমার দাবি আন্দোলনরতদের)।
একদম স্পষ্ট যে দাবী সেটি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% থেকে কমিয়ে ১০% এ নিয়ে আসতে হবে। বাকী দাবীগুলো আনুষঙ্গিক মাত্র। ১৯৭২ সালে চালু হওয়া এই কোটা পদ্ধতি সময়ের প্রয়োজনে হয়তো সংস্কারের দাবী রাখে। কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কিংবা একজন প্রান্তিক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যদি বিশেষ সুবিধা ভোগ করে তাহলে আপনার মেধার বিকাশ হচ্ছে না! এবং সেটা শুধুমাত্র চাকরীর ক্ষেত্রে। তার মানে হলো আপনার মেধা শুধুমাত্র একটি সরকারী চাকরীর মাঝেই সীমাবদ্ধ। মেধার ভিত্তিতে ৩৩তম বিসিএসে ৭৭.৪০ শতাংশ, ৩৫তম বিসিএসে ৬৭.৬৯ শতাংশ এবং ৩৬তম বিসিএসে ৭০.৩৮ শতাংশ ক্যাডার সরকারি চাকুরীতে নিয়োগ পেয়েছে। অর্থাৎ কোটায় যোগ্য মেধাবীদের না পাওয়া গেলে বাকিদের থেকে তা পূরণ করা হয়। এছাড়া জেলার বাসিন্দা হিসেবে সব মেধাবীরাই কোটার আওতায় পড়ে। নারী হিসেবে প্রত্যেক মেধাবী নারী কোটার মধ্যে পড়ে। জেলা কোটার ক্ষেত্রে প্রত্যেক আবেদনকারীকে, স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়। ভয়ংকর রকম মেধা নিয়ে একটি চাকরীর বাইরে আর কিছুই চিন্তা করতে পারছেন না। ভালো লাগতো যদি প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন হতো। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে তো বহু মেধাবীর সমান রেজাল্ট করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীও। চাকরীর ইন্টার্ভিউর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই নিয়ে তথাকথিত মেধাবী ভাই-বোনদের কোন আন্দোলন চোখে পড়ে নাই। পরীক্ষা বাতিল করো বা নিয়োগ বাতিল করো বলে। কোটার ভিত্তিতে কাকে নিয়োগ দেয়া হয়? নিশ্চয়, এসএসসি পাশ কাউকে কোটা ব্যবস্থায় বিসিএস ক্যাডার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়না? এবং লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ দেয়া হয়না। অনেকেই বলছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোটা ব্যবস্থা নেই। কিন্তু বহু উন্নত দেশ সমূহে কোটা ব্যবস্থা না থাকলে ও বিশেষ বরাদ্দ বা তহবিলের ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা নাই। নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে মূল ধারায় অংশগ্রহণে যদি আপনি সামান্যতম সুযোগ দিতে রাজী না থাকেন, আন্দোলনকারীগণ কি কোন বিকল্প ব্যবস্থা সুপারিশ করেছেন। তাহলে এই রাতজাগা আন্দোলন কেন? আপনারা নিজের দেশের, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ওয়েব সাইট হ্যাক করলেন। ভিসির বাসভবনে হামলা করলেন এর সাথে কোটার সম্পর্ক কোথায়?
২০১৩ সালে মার্চ মাসে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়ানোর কথা মনে আছে নিশ্চয়? যেমন গুজব ছড়িয়ে ছিল ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ নিয়ে। ঠিক একই কায়দায় দেখলাম পুলিশের খণ্ডিত বক্তব্য, ছাত্রী হলে হামলা, পায়ের রগ কাটা, অমুক ছাত্রের চোখে গুলি লাগা এই জাতীয় নানাবিধ ছবি ভিডিও দিয়ে মিথ্যাচার করে মেধাবী গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যা ২০১৩ সালের জামায়াত শিবিরের সেই ধরণকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সাঈদীর চন্দ্র বিজয়ের মতো, কোটা বিরোধী আন্দোলনকে গুজবে পরিণত করতে চাইছে। ধরুন কোন কারণে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হলেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেনি। এইবার চিত্রটা দেখুন শতকরা ১৫ জন ছিলেন সরকারি চাকরীতে। সেনাবাহিনীতে ছিলেন শতকরা ১০ জন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ আর বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চিত্র ও চরিত্র ভিন্ন। এতো রক্ত, এতো আত্মত্যাগ খুব কম জাতির ক্ষেত্রেই আছে। যারা সেদিন প্রাণ দিয়েছেন। জীবন বাজী রেখেছিলেন, তাঁরা এই সামান্য চাকরীর কোটা চিন্তা করে করেন নাই। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টা ধারণ করার। যারা কোটা প্রথা বাতিলের আন্দোলন করছেন, তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতেই পারেন সেই অধিকার তাদের আছে। কিন্তু কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল বা কমিয়ে আনার সুযোগ তাদের হাতে থাকলে, আমি নিশ্চিত চাকরী ভিখারিদের মুখের উপর এই কোটা ছুড়ে দিতেন। আপনার পূর্ব পুরুষ আন্দোলন করেছিল ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার জন্য। কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে মূলত সমাজের উঁচু তলা ও নীচতলার বৈষম্যকেই ধরে রাখতে চাইছেন। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। তাই এমন আদর্শবিহীন মেধাবী থেকে মুক্তিযোদ্ধার কোটা ভিত্তিক, কম মেধাবী আদর্শবান সন্তানই উত্তম।-জুয়েল রাজ, ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক