সিলেট ছাত্রলীগে খুনের মিছিল
ওয়েছ খছরু:-
‘ভাবতে অবাক লাগে। এ রকম সংস্কৃতি হলো কেন সিলেটের রাজনীতিতে? কথা বললেই খুনাখুনি এবং কাপুরুষের মতো খুন করা হলো তাকে। মাসুমের ছোট ভাইকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এবং ফোন করে বলা হয়েছে তার ভাইঅ্যাকসিডেন্ট করেছে। সে সরল মনে ফোনের নির্দেশনা মোতাবেক হাতিম আলী স্কুলের ওখানে যেতেই তাকে ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করা হয়। ধোঁকা দিয়ে তো অনেক কিছু করা যায়। এরা কাপুরুষের দল।’ সিলেট ছাত্রলীগের সুরমা গ্রুপের কর্মী জাকারিয়া মুহাম্মদ মাসুমকে খুনের ঘটনার পর সিলেট জেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম আহমদ নিজের ফেসবুকে এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ওই স্ট্যাটাসে তিনি আরো বলেন, ‘সিলেটের নেতৃবৃন্দকে বলি- পুলিশ কর্মকর্তাদের এক একটি ফোন দিয়ে বলুন যে- তার সুবিচার পাওয়ার জন্য যে-ই হোক, যে কোনো গ্রুপের হোক, যে কোনো দলের হোক তাকে আইনের আওতায় এনে সুবিচারের দরজা খুলে দেন এবং এই পবিত্র নগরীতে আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয় সেই প্রতিশ্রুতি আদায় করুন।’ সিলেট ছাত্রলীগে নিজেদের অভ্যন্তরে হানাহানির ঘটনায় শুধু জেলা যুবলীগ সভাপতিই নয়, অনেকের মনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যুবলীগের সভাপতির এমন স্ট্যাটাসেই সেটি প্রমাণিত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৭ বছরে সিলেটে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগের ৭ কর্মী খুন হয়েছে। আর এসব খুনের ঘটনার বিচার হয়নি একটিরও। খুন হওয়ার পর আবার অনেককেই ছাত্রলীগ পরিচয় দেয়াও হয় না। অথচ খুন হওয়া কর্মীরা মিছিল-মিটিংয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকেন। সর্বশেষ গত বুধবার দুপুরে সিলেটের শিবগঞ্জে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে নিহত হন সুরমা গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। এ ঘটনায় নিহতের মা আতিয়া বেগম বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শাহপরাণ থানায় এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা টিটু চৌধুরীসহ ২২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। আসামিদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন শাহপরাণ থানার ওসি আখতার হোসেন। ইতিমধ্যে এজাহারনামীয় দুইজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে, এখনো গ্রেপ্তার হয়নি টিটু চৌধুরী। এ খুনের ঘটনায় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ক্ষোভ ও উত্তেজনার কমতি নেই। সুরমা গ্রুপের কর্মীরা এ ঘটনায় হতবাক হয়েছেন। এদিকে- ছাত্রলীগের বিরোধের বলি হন ছাত্রলীগ কর্মী উদয়ন্দু সিংহ পলাশ, সুমন চন্দ্র দাশ, আব্দুল আলী, কাজি হাবিবুর রহমান, আব্দুল্লাহ কচি ও খালেদ আহমদ লিটু। ২০১০ সালের ১২ই জুলাই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে নগরীর টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন পলাশের বাবা বীরেশ্বর সিংহ। ২০১৪ সালের ১৪ই জুলাই সিলেট নগরীর মদিনা মার্কেট-কালিবাড়ি রোডের মদিনা মার্কেট অংশে ইজিবাইকের (টমটম) একটি নতুন স্ট্যান্ডের দখল নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা ইমরান আহমদ ও গোলজার আহমদ গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ ওরফে কচি নিহত হয়। এ ঘটনায় কচির ভাই আসাদুল হক ভুঁইয়া বাদী হয়ে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন। মামলাটি এখন সিআইডিতে তদন্তাধীন। একই বছরের ২০শে নভেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের পার্থ-সবুজ গ্রুপের সাথে অঞ্জন-উত্তম গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী সুমন চন্দ্র দাস। এ ঘটনায় সুমনের মা প্রতিমা দাস বাদী হয়ে ছাত্রলীগের অজ্ঞাতনামা শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করেন। এই মামলাটিও এখন সিআইডি তদন্ত করছে। ২০১৫ সালের ১২ই আগস্ট দুপুর আড়াইটায় সিলেট মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ দলের ক্যাডারদের ছুরিকাঘাতে খুন হন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার থানার সিলাম তেলিপাড়া গ্রামের আকলিস মিয়া আরকানের ছেলে আব্দুল আলী। তিনি ছাত্রলীগ বিধান সাহা গ্রুপের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ঘটনার দিন বিকালে দক্ষিণ সুরমা থানার চন্ডিপুলস্থ ফুলকলি মিষ্টিঘর থেকে আটক করা হয় মূল ঘাতক সিলেটের ওসমানীনগর থানার দয়ামীর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাশের ছেলে প্রণজিৎ দাশ ও সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের বাসিন্দা হারুনুর রশিদের ছেলে আঙ্গুর মিয়া। এ ঘটনায় ১৫ই আগস্ট প্রণজিত দাশ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। ২০১৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিলেটে আসার আগের দিন ছাত্রলীগের গ্রুপিংয়ের শিকার হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী কাজী হাবিবুর রহমান। ওইদিন সকাল সাড়ে ১১টায় নগরীর শামীমাবাদে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মাঠে ছাত্রলীগ নেতা হোসাইন মুহাম্মদ সাগর ও সোহেলের নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগ কর্মী তার ওপর হামলা চালায়। এ সময় হাবিবকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তারা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় হাবিবের। এ ঘটনায় নিহতের ভাই ১১ জনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। চলতি বছরের ১৭ই জুলাই সোমবার দুপুরে সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের শ্রেণিকক্ষের ভেতরে নিজেদের পাইপগানের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক পাভেল গ্রুপের সমর্থিত কর্মী খালেদ আহমদ লিটু। পরে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ ও সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে খালেদ আহমদ লিটু ছাত্রলীগ কর্মী নয় দাবি করে বলেন, ‘লিটু আসলে ছাত্রলীগের কর্মীই নয়। লিটু একজন অছাত্র এবং মোবাইল দোকানের স্বত্ব্বাধিকারী।