নজির হোসেন:-–জনাব আব্দুল হাই সাহেবর সাথে আমার দেখা হয় উনসত্তর সালে প্রথম ভাগে ৷ ভাদেশ্বর হাইস্কুল ম্যানেজিং কমিটি আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহি সাব্যস্থ করে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয় ৷ আমি সুনামগঞ্জ চলে আসলাম ৷ খোঁজ নিয়ে জানলাম একমাত্র হাজী মকবুল হোসেন পুরকাস্থ (এইচ,এম,পি) হাইস্কুলে কেবল বিজ্ঞান শিক্ষকের পদ খালি আছে ৷ চাকুরীর দরখাস্তটা নিয়ে এইচ,এম,পি হাই স্কুলের হেড মাষ্টার সাহেবের রুমে চলে গেলাম ৷ স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন জনাব মুহাম্মদ আব্দুল হাই ৷ বাড়ী শহরের আরপিন নগরে ৷ গুরু গম্ভীর ,বাবরী চুল, স্নিগ্ধ একটা হাসি ঠোঁটে সর্বদা লেগে থাকে। ধুর্জটি কুমার বসু রাখালদা আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন ৷ হেড স্যার আমার বাড়ী ঘর ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। মেট্রিক ,এইচ,এস সি। বি,এ্স,সি এর মার্ক সিট ও রেজাল্ট দেখলেন ৷ মেট্রিকে অংকে দুটি লেটার ছিল ৷ ইলেকটিভ ম্যাথমেটিক্স ও সাধারন অংকে ৷ আমার দরখাস্তে নিয়োগ দেওয়া হলো লিখে কেরানী সাবকে ডেকে ফাইলে রাখার নির্দেশ দিলেন ৷ আগামীকাল থেকে ক্লাশ করার জন্য ব্যবস্থা করতে রাখালদাকে বলে দিলেন ৷
জনাব হাই সাহেব ছিলেন বিরাট পন্ডিত মানুষ। এত জানাশুনা লোক সুনামগঞ্জে ছিলনা। তার বিরাট ব্যাক্তিগত লাইব্রেরী আমার কাছে ছিল সুনামগঞ্জের জ্ঞান ভান্ডার। গান, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ লিখতেন, সুরমা নামে একটা পত্রিকা বের করতেন। সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমী গড়ে তোলেন ৷ হাছন মেলা করতেন। সংবাদপত্র সম্পাদনা করতেন। জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন ৷ আমাকে নাম ধরে ডাকতেন, আদর করতেন। তার প্রশ্রয় না পেলে মাষ্টারী করে আমার রাজনীতি করা কঠিন হতো । আমি যখন ৬৯ সালের প্রথম ভাগে সুনামগঞ্জ আসি তখন জনাব আব্দুল হাই সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের অবসর কাল বলা চলে ৷ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। আইয়ুবী মার্শা ল আমলের বিরোদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকার জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছিল ৷ জেল থেকেই তিনি বিএ পাশ করেন ৷
১৯৬২ সালে তিনি এইচএমপি হাই স্কুলে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন এবং ৭৩ সালে শেষ হয় ৷ সে বছরে পৌর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। নির্বাচন তাকে হতাশ করে ৷ জীবন জগত সম্পর্কে তখন থেকে উদাসীনতা তৈরি হয় ৷ মানুষের প্রতি ভালবাসা এক উপেক্ষার বস্তুতে পরিনত হয় ৷ ৬ দফা আন্দোলনের তিনি ছিলেন গুরতর সমর্থক ৷ প্রকৃত আওয়ামীলীগার ৷ এক সময় তিনি সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ৭০ এর সাধারন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে তার নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্ধন্ধিতা করার কথা ছিলো । কিন্তু সে আকাংখা বাস্তবায়ন হয়নি। তার ব্যর্থতার পেছনের খেলুয়ার ছিলেন স্থানীয় আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী দু’ একজন নেতা।
৭০ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের নৌকার প্র্তীকে সুনামগঞ্জ সদর তাহিরপুরে এবং জামালগঞ্জ অংশে এমএনএ এবং সুনামগঞ্জ তাহিরপুর সিটে এমপিএ সিটে লোক খোঁজ ছিলেন ৷ সে সময় সারাদেশে শিক্ষিত মেধাবী ও তরুন নেতৃত্ব গড়ে উঠে। সে হিসাবে বঙ্গবন্ধুর পছন্দের ছিলেন ছাতকে আব্দুল হক ও সুনামগঞ্জ তাহিরপুর আসনে আব্দুল হক সাহেবের সহপাঠি ও বন্ধু আব্দুল হাই। এমএনএ ,এমপিএ দুটি পদেই প্রতিদ্বন্ধিতা করার যোগ্যতা ছিল হাই সাহেবের ৷ পিডিপি দলের কেন্দ্রীয় ও গুরুত্ব পূর্ণ নেতা মাহমুদ আলীর সাথে পাল্লা দিতে রাজনৈতিক কৌশলের কথা বলে মাহমুদ আলীর পরিবারের ঘনিষ্ট আত্মীয় দেওয়ান ওবায়দুর রাজার প্রার্থীতার পক্ষে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের কেউকেউ মত প্রকাশ করেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন মাহমুদ আলী পরিবারকে সুনামগঞ্জে পরাজিত করার সব কিছু করবেন ৷ মূলতঃ এ সব নেতারা রাজনীতিতে মুহাম্মদ আব্দুল হাইয়ের উত্তান কিছুতে মেনে নিতে পারছিলেন না।
৭০ সালে সুনামগঞ্জ আওয়ামীলীগের নেপথ্যে নেতা জনাব হোসেন বখত সাহেবের সাথে গভীর রাজনৈতিক সখ্যতা ছিল আমার ৷ বখত সাহেব প্রকাশ্যে আওয়ামীলীগার হলেও গোপনে ছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টির গ্রূপ সদস্য ৷ তার ছদ্মনাম ছিল রঞ্জন ৷ সুনামগঞ্জ শহরে ১নং ডেনটির দায়িত্বে ছিলেন বখত সাহেব ৷ বরুনদার চিঠি নিয়ে সুনামগঞ্জের রাজনীতিবিদের মধ্যে বখত সাহেবের সাথে আমি দেখা করি ৷ তখন সুনাগঞ্জের গোপন কমিউনিষ্ট পার্টিতে আমার একক দায়িত্ব ছিলো ৷ বখত সাহেবের সাথে যুক্ত হলে পার্টিতে আমাদের দু’জনের অঘোষিত নেতৃত্ব প্রতিষ্টিত হয় । বখত সাহেব স্থানীয় আওয়ামীলীগের অনেক স্বীদ্ধান্তের ব্যাপারে মাঝেমধ্যে আমার পরামর্শ চাইতেন।
সুনামগঞ্জ ও আহিরপুর আসনে এমএনএ পদে নৌকার জন্য কে প্রার্থী ভাল হবে আমার পরামর্শ চাইলে আমি হাইসাবের নাম প্রস্তাব করি। কিন্তু দলের সুবিধাভোগী কারোকারোর বিরোধিতার কারনে শেষ মূহূর্তে দেওয়ান পরিবার থেকে দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এমপিএ পদেও জনাব হাইসাব ও জনাব আব্দুজ জহুর সাহেবের নাম আসতো ৷ এক্ষেত্রে আমি নীরব থাকতাম ৷ জনাব আব্দুজ জহুর ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আর হাইসাব ছিলেন আমার চাকুরী দাতা। বিশাল পন্ডিত মানুষ ৷ আব্দুজ জহুর গনতন্ত্রী পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে আওয়ামী লীগ যোগদেন ৷ আর হাইসাব তৎ সময়ে রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরে ছিলেন ৷ এই দিক থেকে রাজনৈতিক পছন্দটা জনাব জহূর সাহেবের দিকে চলে যায় ৷
স্বাধীনতার পর শহরের পুরাতন বাসষ্টেশনে অবস্থিত আব্দুল হাই সাহেবের মালিকানাধীন মুর্শেদী প্রেসে প্রায়ই যেতাম ৷ রাজনীতি ,মানুষ ও পারিপার্শিকতার বিরুদ্ধে তার মানসিক ক্ষোভ বাড়ছিল ৷ বরুনদার কাছ থেকে জানতে পারি হাইসাহেব একসময়ে কমিউনিষ্টপার্টির গ্রুপ সদস্য ছিলেন ৷ বিভিন্ন কারনে তিনি আর কমিউনিষ্টপার্টিতে সক্রিয় থাকেননি। আমি যখন মাধ্যমিক শিক্ষকদের একটি মহকুমা ব্যাপি সংগঠন দাড় করিয়ে ফেলি তখন একদিন হাইসাহেব আমাকে ডেকে আমার রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাইলেন ৷ অকপটে তার কাছে সব প্রকাশ করলাম ৷ গোপন সিপিবির মহকুমা সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং আমাকে সাহায্য করতে অনু্রোধ করলাম ৷ হাই সাহেব নিজের কাহিনী বললেন। হাইসাহেবের মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল যে তিনি দেশের জন্য পার্টির জন্য কিছুই করতে পারছেন না ৷ আবেগ ও ভাবুকতা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট ছিল ৷ যার জন্য তার শেষ জীবন “ হাছনপছন্দ” ভাবুকতা তার অন্তিম জীবনের ছন্দপতন ঘটিয়েছে ৷ আরপিনগর হয়তো এত উচু মাপের ব্যক্তিত্ব আর উপহার দিতে পারবেনা ৷
আমার বেতনটা মাসে ২৫০ টাকা তিনিই নির্ধারন করে দিয়েছেন ৷ কারন অন্যান্য মাষ্টারদের বেতন আমার ছেয়ে কম ছিল ৷ আমি যখন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বেতন আনতে গেলাম তখন তিনি বললেন আগামীকাল এসো ৷ ঐ সময় সব কিছু অচল হয়ে গেছে ৷ ছাত্রদের স্কুল আগমন কমে গেছে ৷ ছাত্রবেতন পরিশোধ একদম হচ্ছিল না ৷ স্কুলের কেশ প্রায় শূন্য ৷ পরেরদিন গেলে আমার হাতে ২৫০ টাকা দিয়ে বললেন আর কাউকে এই মাসে বেতন দিতে পারবোনা ৷ আগামী জীবনটা তোমাদের কেমন কাটবে জানিনা ৷ লড়াইতো শেষ পর্যন্ত আমাদের করতে হবে ৷
এই সময় সারাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময় চলছে ৷ কি হতে যাচ্ছে হাইসাহেবকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, যুদ্ধ অনিবার্য ৷ আলোচনা ব্যর্থ হবে ৷ তোমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও ৷ কিছু দিন পর মুক্তিযূদ্ধের প্রথম প্রস্ততি স্বরূপ সুনামগঞ্জ শহরে ৫০ জনের বাহিনী গঠন করা হলো। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। হাইসাহেবের বিজ্ঞান শিক্ষকের স্কুলে হাজিরা নেই ৷ ছাত্র পাঠিয়ে আমাকে ডেকে আনলেন সর্বশেষ খবর জানার জন্য ৷ স্কুলে কেন আসিনা জানতেন ৷ সারাদিনতো সংগ্রাম আন্দোলনের কাজে ব্যস্ত থাকতাম ৷ উৎসাহ দিতেন পরামর্শ দিতেন ৷ নিজে যেতে পারছেন না অনুশোচনা করতেন ৷ ৬৯ ,৭০ ,৭১ সব সময়ই আমাকে সহযোগীতা করেছেন ৷ সংগঠন করতে গ্রামে চলে যেতাম ৷ হাইসাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিতে অসুবিধা হতো না ৷
হাই সাহেবের ছিল সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস ৷ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সংগঠক হয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু ৷ জনাব আব্দুল হাই ছিলেন প্রগতিশীল ধারার রাজনীতির অনুসারী। ৫১সালে শেষ দিকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন হিসাবে ‘সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন’ সর্ব প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। জনাব আ্দুল হাই ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম সংগঠক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন । পঞ্চাশের দশকে তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িয়ে যান ৷ আওয়ামী লীগের সুনামগঞ্জ মহকুমা সম্পাদক হন ৷ জেলে যান ৷ এই দিক থেকে ৭০ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার দাবী করার যোগ্যতা তার ছিল ৷ ৭০ নির্বাচনে নমিনেশন না পাওয়া ৭৩ সালে তাকে বিদ্রুহী করে তোলে ৷ সেই বছর দেওয়ান ওবায়দুর রেজাকে চ্যালেঞ্জ করে পৌরসভা নির্বাচনে তিনি আওয়ামীলীগের সমর্থনে দলীয় প্রার্থী হন। নির্বাচনে প্রার্থী হতে দলের যারা তাকে উৎসাহিত করেছিলেন পরে এরাই তার বিপক্ষে কাজ করেন। ফলে যা হবার তাই হলো। সবার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ঘরে তোলা তার পক্ষে আর সহজ হলো না ৷
আমি প্রায়ই মুর্শেদী প্রেসে আসতাম ৷ আমাকে তার লাইব্রেরী দেখাতে বাড়ীতে নিয়ে যেতেন ৷ ‘৭৩ সালের নির্বাচনের পরই তার মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম ৷ তখন তার মধ্যে আধ্যাত্মবাদ বিকশিত হচ্ছিল ৷ ১৯৭৪ সালে মস্কোতে ১৮ মাস অতিবাহিত করে দেশে ফিরি। দেশে পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ৪বছর আত্মগোপন ছিলাম। আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে ১৯৭৯ সালে বাসষ্টেন্ডে মইনুলের গুলবাগ হোটেলের সামনে তার সাথে দেখা হলো । মনে হলো তিনি আমাকে চিনতেই পারছেন না ৷ কোন সম্ভাষন ছাড়াই হাছন পছন্দের মাহাত্ম বুঝাতে লাগলেন ৷ ৮৩ সালে তার মৃত্যুর সংবাদ পেলাম কিন্তু হুলিয়া থাকার কারনে দেখতে যেতে পারিনি ৷ তার করুন পরিনতি আমাকে মর্মাহত করেছে ৷ কিছু মানুষ তার শ্রেষ্টত্ব দিয়েনীরবে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা কেড়ে নিতে পারে। জনাব আব্দুল হাই ছিলেন তাদের একজন ৷
লেখক- রাজনীতিবিদ । সাবেক সাংসদ। সুনামগঞ্জ ১, তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও জামালগঞ্জ।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
২১৯ বার