সুনামগঞ্জের হাওরে ‘আফাল’ আতঙ্ক, ১২ দিনে ভেঙেছে ১৯ হাজার ঘরবাড়ি
চারদিকে থৈ থৈ পানি। কিছু দূর পর পর একখণ্ড উঁচু ভূমি— ছোট দ্বীপের মতো একেকটা গ্রাম। পানির কারণে ঘর থেকে বের হওয়ার জো নেই। এ পানিতেই ধান গেছে, মাছ মরেছে, গেছে গবাদিপশুও। এবার শেষ সম্বল ঘরটুকুও যাচ্ছে। হাওর আর নদীর বড় বড় ঢেউয়ে ভেঙে পড়ছে ঘরবাড়ি। হাওরের মানুষ এমন বড় ঢেউকে বলে ‘আফাল’। হাওরজুড়েই এখন ‘আফাল’ আতঙ্ক।সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়া হাওড়পাড়ের ছোট্ট গ্রাম চেলাবাড়ি। চেলাবাড়িতে পরিবারের সংখ্যা ৬০টি। সব পরিবারকেই আফালের আঘাত সইতে হয়েছে। সবারই ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারো বাড়ির আঙিনা তলিয়ে গেছে। কারো রান্নাঘর ভাসিয়ে নিয়েছে আফাল। আবার কারো কারো ঘরের উপরের কাঠামো ঠিকই আছে, কিন্তু নিচের ভিটে নেই। আফালের ধাক্কায় হাওরের পেটে চলে গেছে ভিটেটুকু।কেবল চেলাবাড়ি নয়, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লাসহ সুনামগঞ্জের উপজেলাগুলো ঘুরে সবখানেই দেখা যায় একই দৃশ্য। আফালের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হাজারো ঘরবাড়ি। ৯ আগস্ট থেকে হাওরাঞ্চলে সর্বশেষ বন্যা শুরু হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক হিসাবমতে, ৯ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ১২ দিনে আফালে ১৯ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে গত এপ্রিলের আগাম বন্যা ও সেই সঙ্গে কালবৈশাখীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩০ হাজার ঘরবাড়ি।
জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, প্রতি বর্ষায়ই হাওড়ে আফাল ওঠে। পানি বেশি হলে ঢেউয়ের পরিমাণ ও শক্তি বাড়ে। এবার পানি বেশি হওয়ায় অনেক বড় ঢেউ হচ্ছে। এতে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট ভেঙে পড়ছে। পানি না কমলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।স্থানীয়দের দাবি, আফালের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা জেলা প্রশাসনের দেয়া হিসাবের চেয়ে বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামগুলোর চারপাশে সরকারি উদ্যোগে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা গেলে আগামীতে আফালের তাণ্ডব থেকে কিছুটা রেহাই মিলবে বলে তারা মনে করছেন।তাহিরপুরের রতনশ্রী পূর্বহাটি গ্রামের নুরুন্নাহার বেগমের কুঁড়েঘর ১৪ আগস্ট আফালে ভেঙে গেছে। এখন তার মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই। থাকছেন প্রতিবেশীর ঘরে। নুরুন্নাহার বলেন, ঢলের পানিতে ফসল গেছে। মাছও মরেছে। তবু খেয়ে না খেয়ে কোনও রকমে টিকে ছিলাম। এখন একমাত্র আশ্রয়টাও চলে গেল। মাঝে মাঝে না খেয়ে তবু থাকা যায়, কিন্তু ঘর না থাকলে থাকব কোথায়? পূর্বহাটি গ্রামের এক পাশে নদী। অন্য পাশে হাওর। একদিকে নদী ভাঙছে। অন্যদিকে ভাঙছে হাওর। গ্রামের কৃষক জানে আলমের বাড়ির রান্নাঘর ভেঙে পড়েছে ক’দিন আগে। এর পর বাড়ির চারপাশে কচুরিপানা জড়ো করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন।জানে আলম বলেন, আফালের কাছে কচুরিপানা টিকবে না জানি, তবু চেষ্টা করে দেখলাম। এছাড়া আর কিছু তো করার নেই।
প্রতি বছরই হাওরে আফালে কিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এবার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। প্রতি বছরই তারা পানি নেমে গেলে শুষ্ক মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত করে। বাঁশ ও খড় দিয়ে বাড়ির চারপাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করেন। কিন্তু এবার ধান তলিয়ে যাওয়ায় খাবারের জোগাড়ই করতে পারছে না। ঘর মেরামত করবেন কিভাবে? জামালগঞ্জ উপজেলার ভূঁইয়ারহাটি গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব তোলা মিয়া বলেন, বর্ষায় ভাঙনের পর প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে গ্রামের মানুষ নিজ খরচে বাড়ির চারপাশে মাটি ভরাট করে। বাঁশ ও খড় দিয়ে বাঁধ তৈরি করে। কিন্তু এবার তো কারো হাতে টাকা নেই। তাই বাড়িঘর মেরামত করারও সুযোগ নেই।এ গ্রামের গৃহিণী সুজনে আরা বলেন, দিন তবু ভালোয় ভালোয় কেটে যায়। কিন্তু রাত হলেই আতঙ্ক দেখা দেয়। ঘুমের মধ্যে আফালে সব তলিয়ে যাবে— এই ভয়ে রাতে ঘুম আসে না। পুরো রাত জেগে সন্তানদের পাহারা দিই।
শাল্লা উপজেলার কামারখাল গ্রামের মৎস্যজীবী রজব আলীরও ঘর ভেঙেছে আফালে। তিনি গ্রামের চারপাশে সরকারি খরচে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। রজব বলেন, খাবার চাই না। ভিটেটুকু রক্ষার সুযোগ করে দিক।তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফেরদৌস আলম আখঞ্জি বলেন, এখন বন্যার পানি কিছুটা নেমেছে। তবে আফালের আতঙ্ক বেড়ে গেছে। প্রতি রাতেই আফাল উঠছে। এতে অসংখ্য বাড়িঘর ভেঙে পড়ছে। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম বলেন, বন্যা, ঢেউ ও কালবৈশাখীতে অনেক মানুষের ঘরবাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে, তার তালিকা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি করে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, পাহাড়ি ঢল ও অতিবর্ষণে হাওড়ে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এ ছয় জেলায় ৫৪১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫১৮টিই প্লাবিত হয়। তলিয়ে যায় মোট ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ধান। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিরূপিত মান অনুযায়ী, এ থেকে মোট চাল উৎপাদনের কথা কমপক্ষে ৮ লাখ ৭৯ হাজার টন।