সুপ্রিমকোর্ট চত্বরের গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণ
এ সময় আদালতের গেটের বাইরে সংবাদকর্মীসহ উৎসুক দর্শকের ভিড় জমে। তবে নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা কাউকে আদালত চত্বরে প্রবেশ করতে দেননি। আদালতের বাইরের সড়কে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রাত তিনটার দিকে ভাস্কর্যটি কংক্রিট থেকে সরানোর কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসে। সুপ্রিমকোর্টের গেটের বাইরে থেকে দেখা গেছে, শ্রমিকরা ভাস্কর্যটির নিচের দিকে কংক্রিটের অংশ বড় হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করছেন। এর চার পাশে বাঁশ দিয়ে এক ধরনের ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে। কপিকল দিয়ে লোহার শিকল বাঁধা হয়েছে। নিচের দিকে ভাঙার কাজ শেষ হলে বাঁশের ফ্রেম এবং লোহার শিকল দিয়ে টেনে ট্রাকে উঠানো হবে। এজন্য একটি ট্রাকও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শিল্পকর্মটি এখান থেকে সুপ্রিমকোর্টের এনএক্স ভবনের সামনে আপাতত রাখা হবে। রাত ২টার দিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভাস্কর্য সরানোর কাজ চলছিল। রাত দেড়টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সুপ্রিমকোর্টের বাইরে কড়া নিরাপত্তা। ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি। তাদের দাবি, ভেতরে কী হচ্ছে তারা তা জানেন না। তবে বাইরে থেকে দেখা গেছে অন্তত ১৫ জন শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন।
এদিকে রাত দেড়টার দিকে ওই ভাস্কর্যটির ভাস্কর মৃণাল হক সুপ্রিমকোর্টের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাংবাদিকদের বলেন, কর্তৃপক্ষ তাকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিতে বলেছে। আগামীতে এনএক্স ভবনের সামনে ভাস্কর্যটি বসানো হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন। কেন সরিয়ে নেয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের ও জনগণের শান্তির জন্য অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। এ ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়াও তেমনি একটি কাজ। তিনি বলেন, অনেকে এটিকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য বলে মনে করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি শাড়ি-ব্লাউজ পরা একটি বাঙালি নারীর ভাস্কর্য। মৃণাল হকের শিল্পকর্মটি মাটির নিচ থেকে তুলে আনা হবে। মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেলের সামনে বলাকা ভাস্কর্য, বিমানবন্দরের সামনে লালন ভাস্কর্য, শেরাটনের সামনে ঘোড়ারগাড়ি নিজ খরচে তৈরি করেছেন তিনি। এর মধ্যে লালন ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মৃণাল হক বলেন, আমেরিকায় আমি রাজকীয়ভাবে ছিলাম। নিউইয়র্ক সিটির বিউটিফিকেশনের দায়িত্বে ছিলাম। আমি সব ফেলে দিয়ে নিজের দেশে এসেছি। আমরা খালি দেশকে মুখে ভালোবাসি। আর আমি প্র্যাক্টিক্যালি ভালোবাসি। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে গেছে, তবু আমি দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাই।
তিনি আরও বলেন, আমি ঢাকা শহরে ২৫টির মতো শিল্পকর্ম করি। অনেকে এগুলো নিয়ে ক্রিটিসাইজ করে। যারা ক্রিটিসাইজ করে তারা তো ভালো কাজ জানে। তাহলে তারা কেন কাজ করে না? তারা কেন ঢাকা শহরে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কাজ করেন না। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আমার গড়া ভাস্কর্যের ওপর হামলা হয়েছে। এগুলো বলতে গেলে তো বিপদ। গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমীর শাহ আহমদ শফী নেতৃত্বাধীন এক দল ওলামার সঙ্গে গণভবনে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরাতে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন।এ মূর্তি অপসারনের বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর কথা হয়। রোজা শুরুর আগে এ ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিল ইসলামী সংগঠনগুলো । বছরের ফেব্রুয়ারিতে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী এক বিবৃতিতে বলেন, সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সামনে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন বাংলাদেশের গণমানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আদর্শিক চেতনার একেবারেই বিপরীত। অবিলম্বে এটি অপসারণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় ইমান, আকিদা ও ঐতিহ্য রক্ষায় লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে।
প্রধান বিচারপতির নির্দেশেই ভাস্কর্য সরানো হচ্ছে : অ্যাটর্নি জেনারেল
সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত গ্রীক দেবী ‘জাস্টিশিয়া’র ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিতে প্রধান বিচারপতি নিজেই নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুক্রবার রাত দুইটার সময় তিনি সাংবাদিকদের এসব তথ্য দেন। এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ভাস্কর্য সরানোর কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান ভাস্কর মৃণাল হক।অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আমাকে ডেকেছিলেন। এসময় ড. কামাল হোসেন, খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান ও সাবেক দায়িত্বশীলরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে আমি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা চাই না। এটি সরিয়ে নেওয়া হোক এবং এমন জায়গায় স্থাপন করা হোক যেন প্রশ্ন না ওঠে। তখন সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমরা উপস্থিত সকলেই প্রধান বিচারপতিকে জানাই। এরপর প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। তার প্রেক্ষিতেই ভাস্কর্যটি সরানো হচ্ছে।
কাঁদলেন ভাস্কর মৃণাল হক
সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানোর সময় সংবাদ মাধ্যমের সামনে কাঁদলেন জাস্টিশিয়া ভাস্কর্যটির ভাস্কর মৃণাল হক। এসময় তিনি বারবার দু’হাত দিয়ে তার চোখ মুছছিলেন। বুধবার ভাস্কর্য সরানোর সময় থেকেই তিনি ভাস্কর্যের পাশে অবস্থান করছিলেন। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে মৃণাল হক জানান, অনেককে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রেসারে (চাপে) আমাকে এটিকে (ভাস্কর্য) সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমাকেই বলা হয়েছে, চাপ দিয়ে সরাতে বলা হয়েছে। ভাস্কর্যটি আরেকজন সরাতে পারলেও এটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনে লালনের ভাস্কর্যটিতে আমি দেড়/দুই কোটি টাকা লস খেয়েছি। সরকারই এটা ভেঙেছে আবার সরকারই চুপচাপ থেকেছে। মতিঝিলে বক পাখি নষ্ট করা হয়েছে। এগুলোতো বলতে গেলে বিপদ।
গতকাল মঙ্গলবার ভাস্কর্য সরানোর বিষয়ে তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। তবে কে বা কারা এই নির্দেশনা দিয়েছেন সংবাদ মাধ্যমকে তা জানাতে রাজি হননি তিনি। মৃণাল হক আরো বলেন, আমি আমেরিকায় রাজকীয়ভাবে ছিলাম। সব ফেলে দেশে ফিরে এসেছি। আমরা শুধু দেশকে ভালোবাসি, এটা মুখে বলি। অনেক আর্টিস্ট আমার পেছনে আছে, কনসেপশন(ধারণা) বলে কিছু ছিলোনা। ঢাকায় ২৫টির মত ভাস্কর্য করেছি। অনেকে আর্টিস্ট ক্রিটিসাইজ করে, তারা কেন নিজেদের টাকায় করেনা? তারা কেন আসেনা? তারা ক্রিটিসাইজ (সমালোচনা) করে আমার কাজের। তারা কেন আসেনা? তিনি বলেন, এই ভাস্কর্যের এখানে গ্রীক মূর্তির কি পাওয়া যায়? এটা বাঙালী মেয়ের ভাস্কর্য। এটি সম্পূর্ণ একটি বাঙালী মেয়ে। শাড়ী, ব্লাউজ পরানো এবং হাতে তালোয়ার দিয়ে সাজানো। এখন কেউ এটাকে সরাতে গিয়ে নষ্ট, চ্যাপ্টা করে ফেলুক তা আমি চাইনা। তাই আমি নিজে নিতে এসেছি।