হাওরপারে এখন নৌকা তৈরির ধুম
জালাল আহমদ::
চারিদিকে অথৈ পানি। পানির নিচে তলিয়ে আছে শত শত ঘরবাড়ি, গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বন্যাকবলিত মৌলভীবাজারের রাজনগরের কাওয়াদীঘি হাওরপারের গ্রামগুলোর আভ্যন্তরীণ যোগাযোগে বির্পযয় নেমে এসেছে। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাতায়াতের জন্য এখন নৌকাই একমাত্র বাহন। বিগত এক দশকে প্রকৃতির রূপ অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিলো। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টি-বাদল কমে যাওয়ায় নিয়মিত বর্ষার ঢল নামেনি হাওর, বাওর ও নদী-নালাতে। তাই ভাটির মানুষেরা নৌকা ব্যবহারের কথা ভুলে যেনো গিয়েছিলো অনেকটা। কিন্তু এবারের দীর্ঘ বন্যায় হাওর জনপদের বাসিন্দাদের চলাচলের জন্য নৌকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নৌকার চাহিদা পূরণে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন নৌকার কারিগরেরা।
একসময় হাওর জনপদে জলে-ডাঙ্গায় বসবাসকারী মানুষের চলাচলে নৌকাই একমাত্র বাহন ছিলো। নব্বই দশকের পর যান্ত্রিক (স্টিল) সভ্যতা ফিরে আসায় নৌকার কদর কে গেলেও চলতি মৌসুমে বর্ষার ঢল আর বন্যা হওয়ায় নৌকার কদর যেনো বেড়েছে।
জেলার রাজনগর উপজেলার কাওয়াদীঘি হাওরপারের গ্রামগুলোতে নৌকা তৈরির ধুম পড়েছে। নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত রয়েছেন কারিগররা। উপজেলার রক্তা, নোয়াগাঁও, ঢেউরবন, মেদেনীমহল, জালালপুর, বেড়কুড়ি, বাগেরবাড়ি, চালবন প্রভৃতি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নৌকার কারিগররা। পানিবন্দী হওয়ার কারণে স্বাভাবিক যোগাযোগের প্রয়োজনে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই নৌকা তৈরি করা হচ্ছে। বন্যা দেখা দেয়ার পর থেকে এলাকায় এ পর্যন্ত দু’শতাধিক নৌকা তৈরি করা হয়েছে।
সরেজমিনে গেলে কথা হয় নৌকা তৈরির কারিগর নোয়াগাঁও গ্রামের সাজ্জাদ আহমদের সাথে। তিনি জানালেন, গ্রামে বন্যা দেখা দেয়ার পর থেকে ১০টি নৌকা তৈরি করেছেন তিনি। প্রতিটি নৌকা তৈরিতে ১০ হাজার টাকা করে মজুরি নিয়েছেন। তিনি আরও জানালেন, বন্যা দেখা দেয়ার পর বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকা তৈরির ডাক পড়েছে একটু বেশি।
সাজ্জাদ আরও জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে হাওরে পানি কম হয় বলে মানুষের খুব বেশি নৌকার প্রয়োজন পড়ে না। এ কারণে প্রতিবছর ৪-৫টি নৌকা বানানোর ফরমাশ পান তিনি। একটা নৌকা বানাতে অন্তত ১২ দিন সময় লাগে। তার সঙ্গে আরও দু’জন সহকারী থাকেন। তিনজনে মিলে নৌকা তৈরি করেন। ১৮ হাত লম্বা একটি নৌকা বানাতে কাঠ, লোহা, আলকাতরাসহ প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়ে থাকে। নোয়াগাঁও গ্রামের বিধু দাস (৩৫) জানান, আমি এবার চাইরটা নাও বানাইছি। আমার গেরস্তি (কৃষিক্ষেত) আছে। অবসর সময় নৌকা বানাই।
উপজেলার রক্তা, নোয়াগাঁও, ঢেউরবন, মেদেনীমহল, পৈতুরা গ্রামে ১০/১২ জন নৌকা তৈরির কারিগর রয়েছেন। কথা হয় ঢেউরবনের গকুল দাশ, গোপেন্দ্র নমঃ শূদ্র, দীনেশ দাশ প্রমুখের সাথে। আলাপকালে তারা জানান, বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন নৌকা তৈরির কাজ চলছে। মাঝে মাঝে দূর-দূরান্তেও আমাদের নৌকা তৈরির কাজে যাওয়ার ডাক পড়ে। সুশেন্দ্র দাশ নামের একজন কারিগর জানান, তিনজন মিলে ৭/৮ দিনে একটি নৌকা তৈরি করা যায়। মেদেনীমহলের সুন্দর মিয়া বলেন, নৌকা বানাইয়া (তৈরি) করিয়া খুব একটা লাভ অয় (হয়) না। খুনোমতো (কোনোমতে) সংসার চলে। কাজ জানা থাকায় লাভের চিন্তা না করে বিপদের সময় পানিবন্দী মানুষকে সাহায্য করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করে থাকি।
এদিকে একইভাবে জেলার বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরপারের গ্রামগুলোতেও নৌকা তৈরি করছেন কারিগরেরা। উত্তাল হাওরে মাছ ধরা কিংবা যাতায়াতে ভরসা এখন তাই নৌকা। কমবেশি প্রতিটি পরিবারেই নৌকা প্রয়োজন। তাই সাধ্য অনুযায়ী নৌকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন হাল্লা, খুটাউরা, আহমদপুর, গগড়াসহ সুজানগর ও বর্ণি এলাকার হাওরতীরের বাসিন্দারা। এ বিষয়ে পাঁচগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান শামসুন নূর আজাদ জানান, কাওয়াদীঘি হাওরে এখনও পানি বাড়ছে। অনেকের নৌকা বানানোর জায়গাও নেই। যারা সুযোগ পাচ্ছেন তারা বানাচ্ছেন।