হাওরে জলাবদ্ধতা: নিরসন করতে হবে দ্রুত
অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে ফসল তলিয়ে যাওয়ার ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি হাওরবাসী। পরপর দুইবার ফসলহানিতে হাওরবাসী পার করছে এক দুর্বিষহ জীবন। অনেকেই আর ফসল ফলাতে চান না। তারপরও কৃষকরা বাপ দাদার পেশা ছাড়তে পারেন না। অভ্যাসের কারণে কিংবা জমির প্রতি মায়ার টানে নিজেকে ফসল ফলানো থেকে বিরত রাখতে পারেন না হাওরের কৃষক। তাই বীজতলার খোঁজে কৃষক হাওরে যান। কিন্তু কোথায় বীজতলা! এতে এখনও ঢেউ খেলছে বানের পানি। কৃষকের কপালের ভাজ আরও দীর্ঘ হয়। এখনই বীজতলা প্রস্তুত করা না গেলে ধান রোপণ করতে দেরি হবে। রোপণ করতে দেরি হলে ধান পাকতে দেরি হবে, কাটতে দেরি হবে। আর ধান কাটতে দেরি হলে যে কী বিপত্তি হতে পারে তা তো কৃষকের জানাই আছে। তাই- ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়ার মতো অবস্থায় আছেন দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার লাখ লাখ কৃষক। অন্যান্য বছর নভেম্বরের শুরুতেই পানি নেমে যায়। তুলে রাখা লাঙল, জোয়াল নামান কৃষক। শুরু হয় ব্যস্ততা। বীজতলা প্রস্তত করতে হয়। কিন্তু এ বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি এসেও হাওরে দেখা যাচ্ছে উথালপাতাল ঢেউ। পানি নামছেই না। তবে কখন শুরু হবে বীজতলা আর চারা রোপণের কাজ?
গতবছর অকাল বন্যা আঘাত হানে মার্চের শেষদিকে। প্রথম ধাক্কাতেই পানি ঢুকে যায় জামালগঞ্জের হালির হাওরে। এরপর একে একে ডুবে যায় সুনামগঞ্জের সবকটি হাওর। শেষ ভরসা হয়ে টিকে ছিল শনির হাওর ও পাগনার হাওর। তাও আর রক্ষা করা গেলো না। কৃষকরা আফসোস করে বলছেন- ইস, বন্যাটা যদি আর পনের দিন পরে আসত, অনেক জমিই (জমির ধান) কাটা যেত! গোলায় কিছুটা হলেও ধান তোলা যেত। এই আফসোকে ধারণ করেই গবেষকরা কৃষকদের স্বল্পজীবনের ধান লাগানোর পরামর্শ দেন। বললেন– ফলন কম হলেও ব্রি ২৯ নয় ব্রি ২৮ জাতের ধান লাগান। কয়দিন আগেই ধান কাটতে পারবেন। এতে আগাম বন্যায় আর ফসল তলিয়ে যাবে না। যেখানে তাড়াতাড়ি ধান কাটার জন্য কম ফলনশীল স্বল্পজীবনের ধান লাগাতে রাজি কৃষক, সেখানে ধান রোপণেই যদি বিলম্ব হয়ে যায় তবে তো ঝুঁকি আরও বেড়ে গেলো। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে হবে। না হয় অকাল বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসল রক্ষা করা কঠিনতর হয়ে যাবে। তাই এই জলাবদ্ধতা এখন হাওরবাসীর জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।
হাওরের এই জলাবদ্ধতা এবারেই প্রথম নয়। গত কয়েকবছর ধরে অনেক হাওরেই কমবেশি জলাবদ্ধতা ছিল। এবছর তা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। হাওরগুলো বছরের ছয়মাস জলমগ্ন থাকে, বাকি ছয় মাস হয়ে উঠে শষ্যের ভাণ্ডার, আবাদি জমি। স্বাভাবিক নিয়মেই পানি আসে আবার স্বাভাবিক নিয়মেই পানি চলে যায়। এমন বিচিত্র জলাভূমি বিশ্বে খুব বেশি দেখা যায় না। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীর নাব্যতা কমার কারণে পানির আসা ও যাওয়া এই দুই ক্ষেত্রেই অনিয়ম এখন নিয়ম হতে চলেছে। দেখা যায় অকাল বন্যায় হাওরে পানি প্রবেশ করে আগেভাগে আর জলাবদ্ধতার কারণে পানি হাওর থেকে বের হচ্ছে দেরিতে। এতে ধান ফলানোর জন্য আগে কৃষক যেটুকু সময় পেতেন এখন আর ততটা সময় পাওয়া যায় না। তাই দেশের শষ্য ভাণ্ডার খ্যাত হাওরের ফসল ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। এভাবে হাওরের পানি যত দীর্ঘ সময় ধরে হাওরে রাজত্ব করবে কৃষকের জন্য তা তত বঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
হাওরে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়া। পাহাড়ি বালি ও পলি পড়ে হাওরাঞ্চলের প্রায় সবকটি নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পড়েছে চর। তাই পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ভৈরবের কাছাকাছি মেঘনা নদীর কিছু অংশে নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় উজানের পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হচ্ছে না। এটি বর্তমান জলাবদ্ধতার একটি বড় কারণ। এছাড়াও কোনও কোনও জায়গায় হাওর এবং নদীর মধ্যবর্তী স্থানও উঁচু হয়ে আছে। কোথাও মৎসজীবী বা ইজারদাররা মাছ ধরার স্বার্থে পানি বের হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাওর থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য নদীগুলো দ্রুত খনন করা জরুরি। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে নদী খননের কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের কয়েকটির কাজ শুরু হয়েছে। তবে অনেক প্রকল্পের কাজ এখনও শুরু হয়নি। দ্রুত এসব প্রকল্পের কাজ শুরু করতে হবে এবং যথা সময়ে শেষ করতে হবে। কোনও কোনও নদী খননে প্রকল্প প্রণয়ন হয়নি। এসব নদী খননের উদ্যোগ নিতে হবে। নদী খননের ক্ষেত্রে যেন হাওরের বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের মতো দুর্নীতি না ভর করে সে ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে। সর্বোপরি নদী খনন প্রক্রিয়ার সফলতার ওপর হাওর সমস্যার সমাধান অনেকাংশে নির্ভরশীল। শুধু জলাবদ্ধতা নয়, অকালবন্যার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতেও নদী খনন আবশ্যক।
একথা সত্য যে নদী খনন প্রকল্প এবছরের জলাবদ্ধতা নিরসন করতে পারবে না। এজন্য প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ। এজন্য কোনও কোনও জায়গায় মাটি কেটে পানি বের হওয়ার পথ করে দিতে হবে। হাওরপারের কৃষকরা দাবি করছেন একসঙ্গে বড়ধরনের কয়েকটা পানির পাম্পের সাহায্যে হাওর থেকে পানি বের করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে হয়তো বাড়তি টাকা খরচ হবে। এই বাড়তি অর্থ কিন্তু খুব বড় অংকের নয়। লাখ দু’য়েক টাকার বিদ্যুৎবিল বা ডিজেল খরচে একেকটা হাওরের পানি বের করা সম্ভব। যেখানে একেকটা হাওরের বাঁধগুলোর জন্য প্রায় কোটি টাকার বরাদ্দ থাকে সেখানে এই বরাদ্দটাকে সামান্যই বলতে হয়। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কোনও হাওরেই কোনও বরাদ্দ নেই। এই বরাদ্দের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও আবেদনও করা হয়নি। জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারকে বিশেষ বরাদ্দ না দিলে এই মুহূর্তে হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয়।
ঠিকমত হাওরের ফসল ঘরে তোলার জন্য সরকার শতকোটি টাকা খরচ করছেন। সরকারিভাবে ৬ লাখ কৃষককে সার, বীজ ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। মিডিয়া, হাওর উন্নয়নকর্মী, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন সবাই তৎপর। কিন্তু ধান যদি রোপণই না করা যায় তবে কি ধান কাটা সম্ভব! তবে আমাদের এইসব প্রচেষ্টা কি বিফলে যাবে না? নাকি ঘর বানানোর আগে দরজা বানানোতেই আমরা ব্যস্ত থাকবো! আবারও কী ফসলহীন আরেকটি বছর কাটাতে হবে হাওরবাসীকে? ভাবতে হবে দ্রুত, সমাধানও করতে হবে দ্রুতই।
লেখক: সভাপতি, পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা