হুজুরের উপদেশ কে পালন করবে?
ইহুদি নাসারারা এরকম কত কিছু আবিষ্কার করেছে, যেসব ছাড়া আমাদের আজকাল চলেই না। আমি কি হিসেব করতে বসবো কী কী ওরা আবিষ্কার করেছে? যেসব যন্ত্রপাতি ছাড়া আমাদের বাঁচা মুশকিল হয়ে যায়, সেসবের প্রায় সবকিছুই ইহুদি নাসারাদের অথবা নাস্তিকদের আবিষ্কার। সত্যি বলতে কী, ইহুদি নাসারাদের করুণা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। অসুস্থ হওয়ার পর শফী হুজুর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশ ভারতে গিয়েছেন ইহুদি নাসারাদের বানানো উড়োজাহাজে চড়ে, হিন্দুদের বানানো অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, চিকিৎসা করিয়েছেন। বলা বাহুল্য হিন্দু চিকিৎসকরাই তার চিকিৎসা করেছেন। ইহুদি নাসারাদের আবিষ্কৃত চিকিৎসাবিজ্ঞান, ওষুধপত্র এবং হরেক রকম মেশিন তাকে সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করেছে।
একবার যদি ইহুদি নাসারাদের আবিষ্কৃত সব জিনিস, সব মতবাদ, সব কানুন আমরা বর্জন করি, তাহলে আমাদের জীবন যাপনের মান ঠিক কোথায় গিয়ে পৌঁছোবে, আমার একবার কি ভেবে দেখেছি? পৃথিবীর জনসংখ্যার ০.২ ভাগ ইহুদি, কিন্তু এ পর্যন্ত ১৯৬ জন ইহুদি পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। ওদিকে পৃথিবীর জনসংখ্যার ২৪ ভাগ মুসলমান, নোবেল পেয়েছেন সাকুল্যে ১২ জন। বিদ্যায়, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, শান্তিতে ইহুদিরা বহু গুণ এগিয়ে আছেন মুসলমানের চেয়ে। মুসলমানরা যে বড় কিছুই আবিষ্কার করেননি, তা কিন্তু নয়। মুসলমানের কিছু আবিষ্কার এখনও আমরা নিত্যই ব্যবহার করি। কফি, সাবান, বাথটাব, পিনহোল ক্যামেরা, উইন্ডমিল, কারপেট, এলজেব্রা, চেক, দাঁতের মাজন, সার্জিকাল যন্ত্রপাতি– স্কাল্পেল ফরসেপ, ওরার যন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, সঙ্গীত। সে তো অনেক কাল হলো, আধুনিক যুগে মুসলমান কেন পড়ে আছে ব্যাকইয়ার্ডে?
পৃথিবী ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। মুসলমানের আবিষ্কার অমুসলমানেরা ব্যবহার করছে, অমুসলমানদের আবিষ্কার মুসলিমরা ব্যবহার করছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং ব্যবহার নিয়ে ধর্মকে টেনে আনা উচিত নয়। কিন্তু তখনই হয়তো টানা উচিত যখন মুসলমানদের ধর্মগুরুরা ইহুদি নাসারাদের প্রতি ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়ে তাদের আবিষ্কারকেও আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখায়। পারবে ইসলাম প্রচারকরা আজকের ইউটিউব আর ফেসবুক ব্যবহার না করে থাকতে? আসলে ধর্মের যেটুকু ভালো দিক, সেটুকু প্রচার করলে ক্ষতি নেই, কিন্তু মুশকিল হলো, উগ্রপন্থীরা বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে অবিজ্ঞান ছড়াচ্ছে। ধর্মের নামে প্রচার করছে ঘৃণা, হিংসে, নারীবিদ্বেষ, সন্ত্রাস, নরহত্যা। সন্ত্রাসীরা যদি মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি ব্যবহার বন্ধ করে, তাহলে মানুষের মঙ্গলই হবে। আরাফাত নামের যে ছেলেটি অভিজিৎ, নিলয়, জুলহাস, তনয়, দীপনকে কুপিয়ে মেরেছে, ওর কাছে নিশ্চয়ই একটি মোবাইল ছিল। ওই মোবাইলেই সে দলের নেতা মেজর জিয়ার নির্দেশ পেয়েছে, যে, নাস্তিক ব্লগারদের কুপিয়ে মারতে হবে। আসলে যুব সমাজকে নষ্ট করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে অসংখ্য উগ্রপন্থী আর সন্ত্রাসীগোষ্ঠী।
সন্ত্রাসীরা বা জঙ্গিরা কোনও না কোনও হুজুরের ভক্ত। হুজুরদের হাত থেকে, জঙ্গিদের হাত থেকে যুব সমাজকে বাঁচানোর কোনও উদ্যোগ কি সরকারি বা বেসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠান নিয়েছে? জঙ্গিদের গ্রেফতার করতে গিয়ে প্রায়ই শুনি পুলিশ মেরে ফেলেছে জঙ্গিদের। মোট কতজন জঙ্গিকে মেরে দেশকে জঙ্গিমুক্ত করবে সরকার? জঙ্গি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে যদি বন্ধ না করা হয়, তবে এক জঙ্গি মরলে আরেক জঙ্গি জন্ম নেবে। নেবেই। জঙ্গিমুক্ত দেশ কোনোদিন জুটবে না। তারচেয়ে যুবকদের কেউ যেন জঙ্গি হওয়ার কুশিক্ষা না পায়, সেদিকে রাখতে হবে কড়া নজর। অনেক সময় ইন্টারনেটেই জঙ্গি হওয়ার লোভ দেখানো হয়, পথভ্রষ্ট হওয়ার পথ দেখিয়ে দেওয়া হয়। যুক্তিবুদ্ধি সব লোপ পাওয়া যুবকেরা হাতে চাপাতি নিয়ে দাঁড়ায়।
আমার মনে হয় না শফী হুজুরের মোবাইল ব্যবহার না করার উপদেশ কেউ শুনবে। যদি শুনতো, কিছুটা হলেও কমতো জঙ্গিদের কার্যকলাপ। মোবাইলে ভালো কাজ যেমন হয়, খারাপ কাজও হয়। ডিনামাইট যেমন ভালো কাজে ব্যবহার হয়, তেমন খারাপ কাজেও। বিজ্ঞান আমাদের যা দিয়েছে, তা খারাপ কাজে ব্যবহার করলে আমরাই ধ্বংস করবো এই পৃথিবী। বিজ্ঞান কিছু লোকে খারাপ কাজে ব্যবহার করে, তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞান খারাপ। সেই লোকগুলো খারাপ যারা বিজ্ঞানকে খারাপ কাজে ব্যবহার করে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য আরাফাত জঙ্গি হয়ে জন্মায়নি। এই সমাজ তাকে জঙ্গি বানিয়েছে। এই সমাজকেই সুস্থ করতে হবে, যেন এটি আর কোনও জঙ্গিকে জন্ম না দেয়।
লেখক: কলামিস্ট