‘৭২ এর সংবিধান ও আজকের বাংলাদেশ
বিনোদ রঞ্জন তালুকদার-
আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ভেবে ছিলাম একটি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ জাতির জনকের নির্দেশে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ধর্ম নিার্পেক্ষতা ও গণতন্ত্র এই চার স্তম্ভের ভিত্তিতে অর্থাৎ ১৯৭২ সনের সংবিধান মোতাবেক পরিচালিত হবে। কিন্তু ১৯৭৫ সনে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসীন হল, স্বাধীনতা বিরোধী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সরকার। এর প্রেক্ষিতে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কার্য্যক্রম। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সরকার সংবিধান থেকে ধর্ম নির্পেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িকতা সুকৌশলে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজাকার আলবদর ও যোদ্ধাপরাধীদের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বসিয়ে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারার নিয়ে যেতে ষড়যন্ত্র শুরু করে “জয়বাংলার” বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ এবং বাংলাদেশ বেতারের পরিবর্তে “রেডিও বাংলাদেশ” প্রবর্তন করে, শুধু এখানেই শেষ নয়ুু বাংলাদেশ সরকার চলনে বলনে সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে, শিক্ষাধীক্ষায় পাকিস্তানি ভাবধারার এবং চিন্তা চেতনায় প্রচার ও প্রকাশ ঘটাতে থাকে। ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বসলেও সব কিছুতে রাজাকার আলবদররা যেন ক্ষমতাসীন হলো। প্রেসিডেন্ট জিয়া যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম কে নাগরিকত্ব দিয়ে পুনর্বাসিত করলো। এমন কি রাজাকার শাহ আজিজকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেশের মসনদকে কুলষিত করার মধ্য দিয়ে এবং জাতির পিতা শেখ মুজিব হত্যার নায়কদের সরকারি পৃষ্ঠ পোষকতায় বিদেশ পাঠিয়ে এবং চাকরিসহ আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে প্রতিষ্টিত করেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া বিএনপি গঠন করে হ্যাঃ নাঃ ভোট দিয়ে অবৈধ ভাবে ক্ষমতাসীন হলো। পার্লমেন্টে রাজাকার, খুনি, দালাল আলবদরদের সদস্য বানিয়েছে। এই ভাবে বিএনপি পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারার দেশ বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু করে। ফলে দেশের মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে থেকেও বাচতে পারেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ স্পৃহায় মুক্তিযোদ্ধাদের জেলজুলুম, অত্যাচার এমনকি মামলা মোকদ্দমা ও গুম খুনের স্বীকার হতে হয়েছে। অনেকে আবার ভয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পুড়িয়ে ফেলেছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতাকর্মী মুক্তিযোদ্ধাগণ। জেলজুলুম কেটেছে অনেক আওয়ামী লীগও প্রগতিশীল ব্যক্তিরা তখন একি অবস্থা সারাদেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ঘুষ দুর্নীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, দেশে আইনের শাসন বলতে কিছুই ছিল না। সর্বত্র রাজাকার আলবদরদের দাপট পরিলক্ষিত হয়। যা রাষ্ট্রের সুশাসনের জন্য অন্তরায়। দেশে বারবার ক্ষমতার হাত বদল হলেও এরশাদ- জিয়া কেউই দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার উদ্যোগ নেয়নি বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করেছে। পুর্নবাসিত করেছে পাকিস্তানি চিন্তা চেতনাকে ফলে দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রস, সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। দেশে ঘুষ দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। কারণ দালাল রাজাকারা সরকারের ছত্রছায়ায় সুকৌশলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মেরে থেকে দুর্নীতি সন্ত্রাসের রাজত্ব্ কায়েম করছে। দেশকে অস্তিতিসীল করার পক্রিয়ায় ব্যাস্ত। দেশে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামী-বিএনপির সাথে ঘাটচড়া বেধে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। স্বাধীনতা বিরোধীরা ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ এবং ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। এরা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ২১শে আগষ্ট শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা করে এতে আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট নেত্রী আইভী রহমান সহ অনেকে হতাহত হন। বিএনপি জামায়াত জঙ্গী বাংলা ভাই ও জঙ্গী আব্দুর রহমানকে সৃষ্টি করে- দেশে সন্ত্রাস জঙ্গীবাদের রাজত্ব কায়েম করে। ফলে দেশের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও লেখককে হত্যা শুরু করে। যাদের মধ্যে লেখক হুমায়ুন আজাদ, ময়েজ উদ্দিন, এস.এম. কিবরিয়া, আহসান উল্ল্যা মাষ্টার, রতন সেন সহ আরো অনেককে হত্যা করে। বিএনপি জামায়াত সরকারের আমলে দশ ট্রাক অস্ত্র অবৈধ পন্থায় আমদানি করে দেশে জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের বিস্তারে সহায়তা করছে। ফলে দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধা বিএনপি জামায়াতের এহেন বর্বর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এমতাবস্তায় ১৯৯৬ সনের সাধারণ নির্বাচনে দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। ফলে দেশে সু-শাসনের বাতাস বইতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযোদ্ধা জনতা ২০০১ সালে ফের শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসীন করে। তারপর থেকে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার ৪৪ বৎসর পরে হলেও রাজাকার, দালালদের বিরোদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার শুরু করেছে। যা ১৯৭১ সনের পরই করা উচিৎ ছিল কিন্তু আমাদের দুরভাগ্য মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা করে যেতে পারেনি। তারপর দেখতে দেখতে অনেক পথ পেরিয়ে গেছে তারপরও জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা হত্যার বিচার করেছে। এমন কি বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচার করেছে। আর এই বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি আজ কলংক মুক্ত হচ্ছে এবং দায় মুক্ত হচ্ছে। জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরন করছে। ফলে দেশ থেকে জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসকে নিমূল করার জন্য অঙ্গীকার বদ্ধ হন। এর প্রেক্ষিতে দেশে জঙ্গীবাদ সন্ত্রাস নিশ্চিন্ন না হলেও আপাতত তাদের কার্যক্রম স্থীমিত বা স্তব্ধ রয়েছে। বর্তমান সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলছে।
আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে দেশমাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করার শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি এবং ৯ মাস অকতোভয় অতন্দ্র প্রহরীর মত যুদ্ধ করি, যার ফলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধ কৌশলের কাছে ক্যাছকা মার খেয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ না পেয়ে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। তবে একটি কথা না বললেই নয় যে, আমরা ১৯৭১ সনে রাজনীতি বুঝে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই নি। শুধু পাকিস্তানিরা আমাদের দেশ অগনতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী কায়দায় দখল করে নিচ্ছে বিধায় দেশ থেকে দখলদার হানাদার বাহিনীকে তাড়ানোর অঙ্গীকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেই। আমারা মুক্তিযোদ্ধারা “জয় বাংলা” শ্লোগানের নিমিত্তে দেশ প্রেমের উন্মাতাল জোয়ারে ভাসছিলাম। বঙ্গবন্ধুর আহবান আসতেই ১৯৭১ সনে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্টার প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধ করি। কিন্তু আমাদের স্বপ্নের সেই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আজও বিনির্মাণ করতে পারি নি। সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ দাঁত উপড়ে ফেলা সম্ভব হয় নি। কারন মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা দেশের বিভিন্ন স্তরে লুকিয়ে থেকে মৌলবাদী চিন্তা চেতনার প্রচার ও প্রসার ঘটাচ্ছে। এমনকি জঙ্গীবাদ লালন করছে যাতে দেশকে ধ্বংস এবং অনিরাপদ করা যায়। এমনকি সুকৌশলে দেশে ঘুষ দুর্নীতি সন্ত্রাস জঙ্গীবাদকে উস্কে দিচ্ছে। তারা এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বা অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারপরও দেশের অগ্রগতি থেমে নেই, দেশের অগ্রগতি হচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় দেশের বিভিন্ন ব্যাংকগুলোর দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যা জাতীয় অর্থনীতির গতিকে শুধু বাধাগ্রস্থ করছে না বরং দেশের অর্থনীতির মানদন্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে তবে সরকার ও সরকারি প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের উদ্যেগ নিলেও, প্রশাসনে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতা বিরোধী চক্র নানা কৌশলে দুর্নীতি বন্ধের উদ্যোগ কে নষ্ট করছে, অন্তরায় সৃষ্টি করছে বা নিরুৎসাহিত করছে। ফলে দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না, বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিধায় যতদিন পর্যন্ত দেশে ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না ততদিন দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। এমতাবস্তায় প্রশাসন সহ সমাজ থেকে যতদিন স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে নিশ্চিন্ন বা নির্মুল করা যাবে না ততদিন দেশ ও জাতির প্রত্যাশিত সোনার বাংলা গড়া প্রায় অসম্ভব। আজকে বিএনপি জামায়াতের দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকার কারনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রায় ম্লান হয়ে গেছে। তাকে বর্তমানে আরো শানিত করতে হবে। প্রয়োজনে স্কুল কলেজ গুলোতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পড়াতে হবে। যাতে এ প্রজন্ম ও আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। দেশপ্রেমে জাগ্রত হয়ে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়। তাই আসুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শোষনহীন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করি। যেখানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জাতীয়তাবাদ সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র অক্ষুন্ন থাকে। এটাই আমাদের বর্তমান ভাবনা।
লেখক : বিনোদ রঞ্জন তালুকদার,সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি,মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ।