আওয়ামী লীগে হঠাৎ আতঙ্ক
ক্ষমতার মেয়াদ যত ফুরিয়ে আসছে ততই চতুর্মুখি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে সম্প্রতি দলটির সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতাকর্মীদেরকে সতর্ক করে দেয়া বক্তৃতা-বিবৃতির পর আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতার পালাবদল হলে নিজেদের ভবিষ্যত পরিণাম কী হতে পারে তারা এখন এনিয়ে ভয়-আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
জানা যায়, কঠিন সংকটের মধ্যেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন কাজী বসিরের গোলাপ বাগানে জন্ম হয়েছিল দলটির। স্বাধীনতার একক দাবীদার দলটি প্রথম সংকটের মুখোমুখি হয় ১৯৭৫ সালে। ৭২ থেকে ৭৫র ১৫ আগষ্টের পুর্ব পর্যন্ত শেখ মুজিবের শাসনকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দু:শাসন হিসেবেই আখ্যা দিয়ে থাকেন। কারণ, সেই সময়ের দুর্নীতি, ব্যাংক ডাকাতি, লুটপাট, দলীয় ও আত্মীয়করণ, ভিন্নমতের লোকজনের উপর দমন-পীড়ন, খুন, হত্যা, গুমের কথা মানুষ এখনো ভুলেনি। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার পরই প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ব্যাপক দলীয়করণ করেছিল। ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই আয়োজন পুর্ণাঙ্গ রুপ নেই।
এদিকে, আওয়ামী লীগ যে প্রশাসনকে কিভাবে দলীয়করণ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে ইউএনডিপির রিপোর্টে। সে রিপোর্টে আওয়ামী দলীয়করণ নীতির ফলে প্রশাসনে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিনা পরীক্ষায় তার দলের অযোগ্য লোকদেরকে ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ভিন্ন মতের লোকদেরকে হত্যার জন্য দলীয় কর্মীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়।
এরপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও একই পথে হেঁটেছে। সন্ত্রাস, রাহাজানি, গুম, হত্যা, নৈরাজ্য, মানবাধিকার লংঘন, রাজনৈতিক দমন পীড়ন, জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড ও আলেম-ওলামাদের উপর নির্যাতন, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, ভারত তোষণ নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বিশিষ্টজনদের মতে, আওয়ামী লীগের চিন্তা-চেতনায় বাকশাল থাকলেও সাংবিধানিক জঠিলতার কারণে পুরোপুরি বাকশালী শাসন ফিরিয়ে আনতে পারেনি। কারণ, সংবিধান সংশোধন করার মত জাতীয় সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ট সংসদ সদস্য ছিল না। তবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। তারা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছে কিন্তু সিস্টেমের কারনে পারেনি।
তারপর ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সঙ্গে আতাঁত করে ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের একটি রুপ দেখানো প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ট আসন নিয়ে সরকার গঠন করার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে । কারণ, নির্বাচনের আগেই সিইসি শামছুল হুদা বলেছিলেন তিনি ৭০র মত একটি নির্বাচন উপহার দিবেন। আওয়ামী লীগের দুই শতাধিকেরও বেশি লোককে এমপি নির্বাচিত করে তিনি তার কথা ঠিক রেখেছেন বলেও অভিযোগ করেছিলেন বিশিষ্টজনসহ বিরোধীদলগুলো।
দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের শাসনের শুরুতেই ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় এক নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত হয় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনাকর্মকর্তা। লুটপাট-আর শোষণ-নির্যাতনের পথ পরিষ্কার করতেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশপ্রেমিক সেনাকর্মকর্তাদেরকে হত্যা করেছে বলে বিরোধীদলসহ বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে।
আর মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারীদের বিচার নিয়েও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় রয়েছে। বিরোধীদলের পক্ষ থেকেও বার বার বলা হয়েছে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে। তবে বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ। কিন্ত সরকার বিচারের নামে যা করেছে তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের লোকজন পর্যন্ত অবাক হয়ে গেছে। বিচারপতির স্কাইপি কেলেংকারী, রায়ের পর আইন করে শাস্তি বাড়ানো ও রায়ের ঘোষণার আগেই তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করেছে। এছাড়া, বিগত সাড়ে আট বছরে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমন-পীড়নের ঘটনাও সীমাহীন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সালাউদ্দিন আহমদ,হুম্মাম কাদের চৌধুরী, জামায়াতের দুই নেতার ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আমান আযমী ও ব্যারিস্টার মীর আরমানের গুমের ঘটনা আলোচিত।
এদিকে, আওয়ামী লীগের সাড়ে আট বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট আর আত্মসাতের মহোৎসব চলেছে। শেয়ারবাজ, হলমার্ক, রেলওয়ে ও পদ্মাসেতু কেলেংকারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে। বলা যায় রাষ্ট্রের সব সেক্টরেই চলছে এখন লুটপাটের মহোৎসব। সরকারের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পই এখন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের লুটপাটের প্রজেক্টে পরিণত হয়েছে। আর সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য থেকেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশ পরিচালনা করে এখন শেষ মুহূর্তে এসে চরম সংকটের মুখোমুখি ক্ষমতাসীনরা।
এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করছে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াতের লোকজন সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এটা নিয়ে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তাদের।
গতকাল চট্টগ্রামে দলীয় এক সভায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না। ক্ষমতা বেশি দিন থাকে না। সরকার ক্ষমতা হারালে টাকা-পয়সা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। তাই সময় থাকতে অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থ দেশের উন্নয়নে ব্যয় করুন। দল যদি ক্ষমতায় না থাকে তখন অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কি করবেন। তাই দলকে ক্ষমতায় রাখতে এবং আগামী নির্বাচনে যাতে আওয়ামী লীগ আবারও জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসে সেজন্য সব অর্থ দেশের জন্য ও জনগণের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করুন।