আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম
ষড়যন্ত্রের ‘ক’ পরিকল্পনা ব্যর্থ ‘খ’ পরিকল্পনাটি কী হবে?
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার এ মাসে দেশে ফেরার কথা ছিল। তিনি ফিরছেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা গেছে, স্বাস্থ্যগত কারণে তাঁকে লন্ডনে আরো কিছুদিন থাকতে হবে। ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে বিতর্কটিও এখন উত্তাপ হারিয়েছে। প্রধান বিচারপতি ছুটি কাটাতে কানাডায় চলে গেছেন। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের সমস্যাটি এখনো রয়েছে। তবে বাংলাদেশ প্রশংসনীয়ভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করছে। মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত। এই তিনটি ঘটনাকেই মনে হতে পারে পরস্পর-বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কনসপিরেসি থিওরিতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা বলছেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একই ষড়যন্ত্রের তিনটি শাখা।
আমি সব সময় কনসপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু মাঝেমধ্যে দেখেছি, এই থিওরি বিস্ময়করভাবে ফলে যায়। লন্ডনে বসবাস করি। দেশ-বিদেশের নানা গসিপ, গুজব কানে আসে। বাংলাদেশ সম্পর্কেও আসে। তার সবই যে সঠিক, তা নয়। কিন্তু এবার একটি নয়, দুটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে যে খবর শুনেছি, তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এই খবরগুলোকে পাশাপাশি সাজালে মনে হবে, হাসিনা সরকার অতীতে অনেক বিপজ্জনক ষড়যন্ত্র সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে জয়ী হয়েছে। এবার একটি কম্বাইন্ড কনসপিরেসি ব্যর্থ করতে সক্ষম হতে চলেছে। তবে এই সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের প্রথম পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হতে চললেও দ্বিতীয় ও বিকল্প পরিকল্পনাটি কী, তা এখনো জানা যায়নি। খালেদা জিয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মুলতবি হওয়ায় এর আভাস মাত্র পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা অবশ্যই শারীরিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু তার সঙ্গে যখন রাজনৈতিক রোগ যুক্ত হয়, তখনই সন্দেহ হয় ‘ডাল মে কুছ কালা হায়’। বেগম জিয়ার অনির্দিষ্টকাল ধরে লন্ডনে অবস্থান ও অবস্থানের মেয়াদ বৃদ্ধিতে তাই নানা গসিপ বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ বলছেন, পুত্র তারেকের হাতে মা বন্দিনী। কেউ বলছেন, ষড়যন্ত্রের প্ল্যান ‘এ’ ব্যর্থ হওয়ায় ‘বি’ প্ল্যান তৈরি করার জন্য মা এখন ছেলের সঙ্গে আরো কিছুদিন বিদেশে অবস্থান করতে চান। এই অনুমান ও গুজবের ভিত্তি হচ্ছে, এবার লন্ডনে আসার পর বিএনপি নেত্রী তাঁর দলের ইউরোপীয় শাখার নেতাকর্মীদের সাক্ষাত্দান করেননি। তাঁর কারামুক্তি দিবস পালন করেছে যুক্তরাজ্যের বিএনপি, তিনি আসেননি। বাজারে গুজব রটেছে, তাঁর সঙ্গে গোপন বৈঠক হচ্ছে পাকিস্তানের আইএসআই, মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গ্রুপ আরাকান স্যালভেশন আর্মির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির। এসব খবর রঞ্জিত-অনুরঞ্জিত কি না জানি না। কিন্তু যেসব সূত্র থেকে খবর পাচ্ছি, তা অবিশ্বাস করার মতোও নয়।
পাকিস্তানের এক সাবেক কূটনীতিক, যিনি এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন, তাঁর মুখে শুনেছি, বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের সামরিক জান্তার একটা ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন আছে। আমার পাঠকদের মধ্যে যাঁরা হলিউডি ছবি ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন (ঋধঃধষ অঃঃত্ধপঃরড়হ) দেখেছেন, তাঁদের কাছে এর বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার নেই। পাকিস্তানের ইচ্ছা, একাত্তরের পরাজয়ের পূর্ণ প্রতিশোধ গ্রহণ, বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ কবজা করতে না পারলে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া। এই লক্ষ্য পূরণে তাদের প্রধান পথের কাঁটা আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকার। তাই আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকারকে ধ্বংস করার জন্য তারা একটার পর একটা চক্রান্ত আঁটছে। বিএনপি অন্ধ ক্ষমতার লোভে নিজেদের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে এই চক্রান্তের সহযোগী হয়েছে। জ্ঞাতসারেই হয়েছে মনে হয়। তারেক রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ও কোনো কোনো জিহাদিস্ট গ্রুপের নেতাদের যোগাযোগ ও গোপন বৈঠকের খবর কি একেবারেই অসত্য?
সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের জন্য বিএনপি ও জামায়াত যুক্ত হয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাস, পেট্রলবোমা হামলা শুরু করেছিল। তার পেছনে যে আইএসআইয়ের সব ধরনের মদদ ছিল, তা তো এখন ওপেন সিক্রেট। বাংলাদেশ ও হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমান চক্রান্তটিরও নীলনকশার জন্ম পাকিস্তানে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে একটি জুডিশিয়াল ক্যু সফল হওয়ার পরই বাংলাদেশে অনুরূপ একটি জুডিশিয়াল ক্যু ঘটিয়ে হাসিনা সরকারকে উত্খাতের পরিকল্পনা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে গ্রিন সিগন্যাল পৌঁছে যায় ঢাকায় বিএনপির কাছে।
পাকিস্তানের মিলিটারি-জুডিশিয়ারি কমপ্লেক্স আজকের নয়। এটা আইয়ুবের আমলে জাস্টিস মুনীর পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি থাকাকালে শক্তিশালী হয়। আইয়ুবের সামরিক অভ্যুত্থানকে তিনি ‘বিপ্লব’ আখ্যা দেন এবং বৈধতা দেন। পাকিস্তানের বিশিষ্ট বাম সাংবাদিক ও লেখক তারিক আলী সম্প্রতি লন্ডনের গার্ডিয়ানে প্রকাশিত তাঁর এক নিবন্ধে বলেছেন, তাঁর দেশে আর্মি ও জুডিশিয়ারির এই জোটবন্ধন এখনো অব্যাহত আছে। দুর্নীতির মামলায় নওয়াজ শরিফের দোষী সাব্যস্ত হয়ে পদত্যাগে বাধ্য হওয়াকে তিনি জুডিশিয়াল ক্যু আখ্যা দিয়েছেন; বলেছেন, দুর্নীতির দায়ে সাজা দেওয়া হলে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সব সদস্য পদ খালি হয়ে যাবে।
পাকিস্তানে একসময় মিলিটারি ক্যুর দ্বারা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়। এর পর পুরনো একটি খুনের মামলায় তাঁকে জড়িয়ে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। বিশ্বের মানুষ এটিকে জুডিশিয়াল কিলিং আখ্যা দেয়। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল অনুৎসাহিত হওয়ার ফলে এখন একই মিলিটারি-জুডিশিয়ারি কমপ্লেক্স সাবেক তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশে জুডিশিয়াল ক্যু দ্বারা সরকার উচ্ছেদ ও ক্ষমতা দখলের পন্থা গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশেও এখন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পথ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। সংবিধানে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ আর্মিতেও পাকিস্তানি মনোভাবের জেনারেলদের বেশির ভাগই অবসরে গেছেন। যে তরুণ ও দেশপ্রেমিক অফিসারা নেতৃত্বে উঠে এসেছেন, তাঁরা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক চক্রান্তে সামরিক বাহিনী জড়িত হোক, তা তাঁরা চান না। এখানেই বিএনপির রাজনীতির বিপত্তি ঘটেছে। দলটির এত দিনের শক্তির উৎসই ছিল ক্যান্টনমেন্ট। দলের কোনো গণভিত্তি এত দিন তারা গড়ে তোলেনি।
বিএনপির যে কোনো গণভিত্তি নেই, তার প্রমাণ সরকারের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলনেও তারা সাড়া জাগাতে পারেনি। অন্যদিকে ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক শক্তির ভিত্তিও ভেঙে গেছে। এখন চক্রান্তের রাজনীতির জাল বোনা ছাড়া এই দলটির সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এবারও তারা একটি বহুমুখী চক্রান্তের জাল বুনেছে এবং আশা করছিল এবার হাসিনা সরকারের পতন হবেই। এবার আর সন্ত্রাস নয়, মিলিটারি ক্যু নয়, একটি জুডিশিয়াল ক্যু ঘটবে। পাকিস্তান তার নজির স্থাপন করেছে। তা শুধু অনুসরণ করলেই চলবে।
আমাদের জুডিশিয়ারি এই চক্রান্তে যুক্ত ছিল বা আছে, তা আমি বিশ্বাস করি না। আমার কাছে যা খবর, তাতে তার কোনো প্রমাণও নেই। কিন্তু আমাদের প্রধান বিচারপতি ‘দশ চক্রে ভগবান ভূত’ হয়েছেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, সংসদের হাত থেকে বিচারপতিদের চাকরি, অপসারণসংক্রান্ত ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে ফিরিয়ে এনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের কবজা থেকে মুক্ত করেছেন বলে দেশ-বিদেশে বাহবা কুড়াবেন এবং ইতিহাসে নন্দিত হয়ে থাকবেন।
তিনি নিজেও এ কথা তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছেন। আমার ধারণা, প্রধান বিচারপতির মনে এই বিশ্বাসটি পাকাপোক্ত করেছেন ড. কামাল হোসেন, হাসিনার প্রতি বিদ্বিষ্ট আর দুজন খ্যাতনামা আইনজীবী, তাঁদের সহযোগী সুধীসমাজটি ও একটি ‘নিরপেক্ষ’ মিডিয়া গ্রুপ। সে জন্যই সম্ভবত ষোড়শ সংশোধনীসংক্রান্ত রায়ের সঙ্গে যুক্ত প্রধান বিচারপতির ‘অবজারভেশন’ বা পর্যবেক্ষণ নিয়ে যখন আপত্তি ওঠে, এমনকি সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকও যখন এই পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করেন, তখন সবার আগে ড. কামাল হোসেনই প্রধান বিচারপতির পক্ষে সাফাই গাইতে তড়িঘড়ি ছুটে আসেন। এই পর্যবেক্ষণে জাতির পিতা সম্পর্কে যে ইঙ্গিতমূলক মন্তব্য ছিল সেটিও ড. কামাল হোসেনের কাছে আপত্তিকর মনে হয়নি। তিনি তার উল্টো ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিএনপির ভূমিকা। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বর্বর সামরিক শাসক ও তাঁর ক্ষমতা দখলকে অবৈধ বলা সত্ত্বেও বিএনপি লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে এই রায় নিয়ে লাফিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যটা বুঝতে কারোই কোনো কষ্ট হওয়ার কথা নয়, ‘মেরেছো কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না?’ বিচার বিভাগকে এই প্রেমে বশীভূত করে নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে তারা লাগাতে চেয়েছে। এই বিবাদ ঘনীভূত হলে বিচার বিভাগ সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যে ১৫০টির মতো আওয়ামী লীগ দলীয় এমপির নির্বাচিত হওয়ার বৈধতা সম্পর্কে আপিল আদালতে মামলা আছে, সেটি দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করে ওই এমপিদের নির্বাচিত হওয়া অবৈধ ঘোষণা করাতে পারলে বিএনপির পোয়া বারো। তাহলে সরকারের পতন ঘটানো যায়। বিএনপি এই মামলাটিতে হাইকোর্টে হেরে গেছে। তাদের আপিল এখনো সুপ্রিম কোর্টে ঝুলছে।
আমার সূত্রের খবর অনুযায়ী, বিএনপি আশা করেছিল সরকারের সঙ্গে বিরোধ যদি তুঙ্গে ওঠে, তাহলে বিচার বিভাগ বিগড়ে যাবে এবং ১৫৪ জন এমপির নির্বাচন অবৈধ এই মর্মে রায় দেবে। এই উদ্দেশ্যে তারা আপিল আদালতে তাদের আপিলের পক্ষে ড. কামাল হোসেনকে দাঁড় করানোর জন্যও নাকি চেষ্টা শুরু করেছিল। কথাটা সত্য কি না তা এই বিজ্ঞ আইনজীবীই জানেন। এই মামলায় বিএনপির জয় হলে হাসিনা সরকারের পতন ঘটবে এবং বিএনপি নির্বাচন সহায়ক সরকার গঠনের নামে তাদের তল্পিবাহক সরকার গঠন করতে পারবে বলে আশা করছিল। আমাদের কথিত সুধীসমাজ ও ‘নিরপেক্ষ’ মিডিয়া গ্রুপটিও এই আশায় বুক বেঁধেছিল।
এই পরিকল্পনা সফল করার লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নির্বাচন সহায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার টোপ দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি। প্রধান বিচারপতির ঘনিষ্ঠ মহলের দু-একজনকে তারা বাজিয়ে দেখতেও চেয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত প্রস্তাবটি পৌঁছানো যায়নি। আমার জানা মতে, প্রধান বিচারপতি তত দিনে এই ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে গেছেন এবং নিজেকে আর কোনো বিতর্কে জড়াবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কানাডায় পৌঁছার পরদিন (১৬ সেপ্টেম্বর, শনিবার) তাঁর সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘রায় মানুষের লেখা। মানুষ মাত্রেরই ভুল হতে পারে। আমি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুজনকেই বলেছি, এই রায়ে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে আমরা তা সংশোধন করে দেব। ’ তাঁর এ কথা শোনার পর আমার মনে হয়েছে, বিএনপি, সুধীসমাজ ও ‘নিরপেক্ষ’ মিডিয়া গ্রুপের বাংলাদেশে জুডিশিয়াল ক্যু ঘটানোর চক্রান্তের এখানেই সমাধি।
তবে এই পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ হয়, সে কথা মাথায় রেখে একটি বিকল্প পরিকল্পনা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তা হলো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী সমস্যা পুনরুজ্জীবিত করা এবং বাংলাদেশ যখন বিরাট বন্যা সমস্যায় ভুগছে, তখন তার মাথায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী চাপিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশের উন্নয়নমুখী অর্থনীতি এই দুই চাপ বহন করতে পারবে না। ভয়াবহ আর্থসামাজিক অরাজকতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, তাতে হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো যাবে—এটাই ছিল তাদের আশা।
এটা এখন জানা, কয়েক যুগ ধরে রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায় মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বৈষম্যনীতি ও নির্যাতনের শিকার। তাদের নাগরিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই বৈষম্য ও বঞ্চনাপীড়িত রোহিঙ্গাদের মধ্যে পুঞ্জীভূত অসন্তোষ আছে এবং তার সুযোগ নিয়ে তাদের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। তাদের অর্থের জোগান, লড়াইয়ের অস্ত্র ও ট্রেনিংদানের ব্যবস্থা রয়েছে প্রধানত পাকিস্তান ও সৌদি আরবে। তাদের হয়ে কাজ করছে জামায়াত। রাখাইন থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার পর্যন্ত জামায়াতের শক্তিশালী ঘাঁটি রয়েছে। এই পাকিস্তানি মদদপুষ্ট আরাকান স্যালভেশন আর্মি গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের কয়েকটি পুলিশ ঘাঁটিতে হামলা চালায় এবং তাতে বহু লোক মারা যায়।
এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নেয় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। তারা সন্ত্রাসীদের ওপর পাল্টা হামলার নামে এথনিক ক্লিনজিংয়ের জন্য বর্বর গণহত্যার নীতি গ্রহণ করে। নিজ দেশের নিরীহ-নিরস্ত্র সংখ্যালঘু নর-নারীর ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। বাংলাদেশে আগেই চার লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছিল, এবার ঢুকেছে তিন লাখ। আরো ঢুকছে। উখিয়ায় আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, এই বর্বরতা বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার সমতুল্য। ’
এখানেই পরিস্থিতির হঠাৎ কেন অবনতি ঘটল এ প্রশ্নটি ওঠে। কোনো সন্দেহ নেই, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের এথনিক ক্লিনজিংয়ের নীতি জোরদার করার জন্য সুযোগ খুঁজছিল। সে সুযোগটি কে তাদের সৃষ্টি করে দিল একটা নির্দিষ্ট সময়ে এবং কী উদ্দেশ্যে? বাংলাদেশে প্লাবনের সময় ও ষোড়শ সংশোধনীসংক্রান্ত রায় নিয়ে যখন একটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন সময় বুঝে এই ভয়াবহ অনুপ্রবেশকারী সমস্যাটি সৃষ্টির কাজে ইন্ধন জোগাল কারা?
একজন বালকেরও এখন অনুমান করতে অসুবিধা হবে না যে এই ইন্ধনটি জুগিয়েছে পাকিস্তানের আইএসআই, সহযোগিতা দিয়েছে আরাকান স্যালভেশন আর্মির প্রধান পৃষ্ঠপোষক জামায়াত এবং তা থেকে ফায়দা লোটার আশা করেছে বিএনপি। তারা নিশ্চয়ই আশা করেছিল, একদিকে বন্যা, অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকট, তার মাথায় লাখ লাখ অনুপ্রবেশকারীর ভার চাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে হাসিনা সরকার আর এক দিনও ক্ষমতায় টিকতে পারবে না। লন্ডনের বাজারে গুজব মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমান্তে একটি তালেবান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আরাকান স্যালভেশন আর্মির সন্ত্রাসীদের পাকিস্তানের আইএসআইয়ের নিযুক্ত যে ব্রিগেডিয়ার ট্রেনিং দিচ্ছেন, তিনি লন্ডনে এসেছিলেন। তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। বাজারে এই গুজবটি এখন প্রবল। সত্যাসত্য জানি না।
তবে বিএনপি নেত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে যে খবরটি জেনেছি, তা হলো, নেত্রী আশা করেছিলেন, লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশে প্লাবনের মতো ঢোকার এই সংকট হাসিনা সরকার কাটিয়ে উঠতে পারবে না। অথবা এই সংকটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রকাশ্য যুদ্ধ বেধে যাবে। এই যুদ্ধ থামানোর নামে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করবে। হাসিনা সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হবে।
এই আশার গুড়েও বালি। রোহিঙ্গা সমস্যাটি শেখ হাসিনা যে সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন, তা তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাফল্যের আরেকটি নজির। রোহিঙ্গা সমস্যায় তিনি সংসদে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছেন। কোনো হুমকির আশ্রয় নেননি। মিয়ানমার সরকারকে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করে সংখ্যালঘুদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া ও নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন। বলেছেন, তাঁর সরকার যদি ১৬ কোটি মানুষের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে থাকতে পারে, তাহলে অতিরিক্ত সাত লাখ মানুষেরও পারবে। তাঁর এই সাহসিকতাপূর্ণ কথা অনুপ্রবেশকারীদের মনে আশা জুগিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মনে সাহস দিয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
শান্তি ও মানবতার পক্ষে শেখ হাসিনার এই দৃঢ় অবস্থান দেখে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল একাডেমিক তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অতীতে একবার ব্রিটেনের লেবার পার্টির তৎকালীন নেতা নিল কিনোক হাসিনাকে শান্তি পদক উপহার দিয়েছিলেন। এবার তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দানের কথা উঠেছে। জনান্তিকে বলে রাখি, এখানেও বাদ সাধতে চাইছেন আমাদের সুধীসমাজের অন্যতম প্রধান অভিভাবক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
খবর বেরিয়েছে, শেখ হাসিনাকে যাতে নোবেল শান্তি পুরস্কার না দেওয়া হয় সে জন্য তিনি নাকি উঠেপড়ে লেগেছেন! বিশ্বের কেন, দেশেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় যাঁর তিল মাত্র অবদান নেই, ক্লিনটন পরিবারের কৃপায় তিনি পেয়েছিলেন অর্ধেক নোবেল শান্তি পুরস্কার। আর নিজ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের জন্য শেখ হাসিনাকে যখন পুরো শান্তি পুরস্কার দেওয়ার কথা উঠেছে, তখন অর্ধেক নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সম্ভবত জ্বলেপুড়ে মরছেন।
রোহিঙ্গা সংকটও আন্তর্জাতিক সমাজের সাহায্যে ও সমর্থনে হাসিনা সরকার কাটিয়ে উঠতে যাচ্ছে। বন্যা, জুডিশিয়ারির সঙ্গে বিরোধ, অনুপ্রবেশকারী সমস্যা—সব সমস্যার কম্বিনেশন ঘটিয়ে হাসিনা সরকারকে উত্খাতের যে কম্বাইন্ড অপারেশন সফল করার আশা বিএনপি নেত্রী পোষণ করছিলেন, তা ব্যর্থ হয়েছে। দেশে বন্যার্তদের পাশে না দাঁড়িয়ে, লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর ত্রাণকাজে অংশগ্রহণের দায়িত্ব এড়িয়ে যিনি চিকিৎসার নামে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন, তাঁর মনে হয়তো আশা ছিল, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যভাগের মধ্যে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কম্বাইন্ড অপারেশনটি সফল হবে। তিনি তাঁর পুত্র তারেক রহমান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য নিয়ে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরবেন। দেশের মানুষ রাস্তায় ফুল ছিটিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানাবে। এই স্বপ্নটি পূরণ না হওয়ায় তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তন স্থগিত করতে হয়েছে বলে আমার ধারণা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুর্নীতির মামলার খড়্গ তো তাঁর মাথায় ওপর এখনো ঝুলে আছে।
এবারও একটা ভয়াবহ ও কম্বাইন্ড কনসপিরেসির জাল কেটে শেখ হাসিনা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তাঁর দেশে ফেরা স্থগিত করেছেন। সম্ভবত তিনি পরাজয় ও ব্যর্থতার কালিমা মুখে মেখে দেশে ফিরতে চান না। বিদেশে বসে ষড়যন্ত্রের নতুন জাল বুনতে চান। তাঁর ষড়যন্ত্রের ‘ক’ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এখন ‘খ’ পরিকল্পনায় হাত দেবেন। সুতরাং আওয়ামী লীগ যেন এই ভেবে আত্মসন্তোষে না ভোগে যে তারা সংকটের সমুদ্র পার হয়েছে। আরো বড় ও ভয়াবহ ষড়যন্ত্র মোকাবেলা ও ব্যর্থ করার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ‘ক’ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে বটে, ‘খ’ পরিকল্পনার চেহারা এখনো আমরা জানি না-সূত্রঃ কালেরকন্ঠ । লন্ডন, সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭