আমেরিকান প্রেম ও ডেটিং
রীতা রায় মিঠু।।
প্রেমের মরা জলে ডুবে না! একটা ঘটনা বলি। আমেরিকায় যে কোনো বয়সে নারী পুরুষ প্রেম করতে পারে। পুরুষ সাধারণতঃ কোনো মেয়েকে সরাসরি “আই লাভ ইউ” বোধ হয় কমই বলে। মেয়েদের মেজাজ মর্জি বুঝার জন্য প্রথমে ছেলেরা মেয়েকে লাঞ্চে নিয়ে যেতে চায়, ডিনারে নিতে চায়। এটাকে বলে ‘ডেটিং’। এমন কয়েকটি ডেটিং করার পর যদি ছেলেটি বুঝে, মেয়েটি তার প্রতি অনুরক্ত, তবেই ছেলেটি সাহস করে ‘ভালোবাসি’ বলে। মেয়েটি যদি সত্যি সত্যি ছেলেটির প্রতি অনুরক্ত হয়, ছেলের ভালোবাসা সে গ্রহণ করে। শুরু হয় প্রেম।
এদেশে ডেটিং করতে চাওয়ার আগে ছেলেরা মেয়েদের হাতের অনামিকার দিকে তাকায়। অনামিকায় ডায়মন্ড রিং থাকলে সেই মেয়ের সাথে ডেটিং করতে চায় না, কারণ মেয়েটি বিবাহিত। এদেশে বিবাহিত ছেলে বা মেয়ে তাদের বিবাহিত জীবনের প্রতি, লাইফ পার্টনারের প্রতি কমিটেড থাকতে চেষ্টা করে।
আমি আঙ্গুলে আংটি পরে থাকতে পারি না, আঙ্গুল ফুলে যায়। আংটি একেবারে আঙ্গুলে বসে যায়। ওয়ালমার্টে যখন কাজ শুরু করেছি ১১ বছর আগে, ডেটিং-ফেটিং এর ব্যাপারগুলো জানতাম না। ৫/৬ বছর আগেও আমাকে দেখতে ৩০/৩২ বছর বয়সের তরুণী নারীদের মত লাগতো। প্রেম নিবেদনের ব্যাপারে কালো জনগোষ্ঠী রেইসে অনেক এগিয়ে। এদের ছেলে আর মেয়ে, উভয়েই একেকজন প্রেমানন্দ/প্রেমানন্দী। তা কাস্টমারই হোক বা সহকর্মীই হোক, আমাকে লাঞ্চে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতো, ডিনারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতো। আমি বাঙ্গালী ভদ্রতায় বলতাম, “আজ নয়, অন্য কোনো একদিন দেখা যাবে”।
একদিন এক কাস্টমার বলেছে, “তোমার কথা এত ভাল লেগেছে, তুমি এত ভাল, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে”।
আমি বলেছি, ” থ্যাংক ইউ”।
সেই লোক বলেছে, ” তোমাকে কি ডিনারে নিয়ে যেতে পারি?”
-আমি উত্তর দেয়ার আগেই আমার পাশে দাঁড়ানো এক তরুণী সহকর্মী বলেছে, “রিটা বিবাহিত, ও তোমার সাথে ডিনারে যাবে না”।
লোকটা বলে, ” তুমি মিথ্যা বলছো। সে বিবাহিত হলে তার আঙ্গুলে আংটি কই? তাছাড়া সে আমাকে থ্যাংক ইউ বলেছে। তুমি মিথ্যে বলছো”।
তখনও আমি জানতাম না এসব ব্যাপার, ভয় পেয়ে আমি বলেছি, “তুমি আমার কাজের প্রশংসা করেছো, আমার কথা সুন্দর বলেছো তাই আমি থ্যাংক ইউ বলেছি। কিন্তু ডিনারে যাব বলিনি”।
সেই লোক চলে যাওয়ার পর আমার সহকর্মী সেদিনই আমাকে অনেক কিছু জানালো। আমাকে এও বলল, কেউ লাঞ্চ ডিনারের অফার করলে সরাসরি বলবে, “আমার হাজব্যান্ড পছন্দ করবে না”।
এরপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, এখন আমাকে সেই আগের মত ৩০/৩২ বছর বয়সের তরুণী দেখায় না। এখনও অনেক প্রেমানন্দ আমার মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণের জন্য, আমার খুব অস্বস্তি লাগে তাই নিজেই চোখ সরিয়ে নেই। কেউ কেউ আমার হাসির প্রশংসা করে, চুলের প্রশংসা করে তবে এখন আর কেউ ডিনারে যেতে, লাঞ্চে যেতে বলে না।
মাঝে মাঝে কেউ কেউ আমার অনামিকার দিকে তাকায়, কেউ কেউ কথাচ্ছলে জিজ্ঞেস করে, “আর ইউ ম্যারিড? তাহলে আংটি নেই কেন”? তখন ঢোপা ঢোপা আঙ্গুলের দিকে দেখিয়ে বলি, “আংটি পরলে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়”।
এক মাস আগের ঘটনা। এক কৃষ্ণ প্রেমানন্দ এসেছে ফোন কিনতে। ফোন কেনার পর সে অনুরোধ করলো তা এক্টিভেট করে দিতে। এরপর সে জানতে চাইলো, দীনেশ প্যাটেল আমার কি হয়? দীনেশ প্যাটেল কে তাইতো চিনি না। তার কাছেই জানলাম, দীনেশ প্যাটেল কাছাকাছি কোন শহরের একটা হোটেলের মালিক। এই প্রেমানন্দ ঠাকুর সেই হোটেলের কেয়ারটেকার।
গল্পে গল্পে সে আরও জানালো, দীনেশ প্যাটেল খুব ভাল মানুষ, তাকে হোটেলের একটা রুমে থাকতে দিয়েছে। মাস শেষে ৮০০ ডলার বেতন দেয়, সে হোটেলের সব কাজ করে। বেশি মানুষ আসেনা তো, তাই কাজের চাপ কমই। তার বউ ছিল, বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। একটা ছেলে আছে ২১ বছর বয়সী, আলাদা থাকে। এই লোকের মা নার্স, নিজের বাড়িতে থাকে। তার কেউ নেই, সে হোটেলের চাকরির পয়সা আর সরকার থেকে পাওয়া এলাউন্স দিয়েই ভালোভাবে চলে যায়। যাওয়ার সময় প্রেমানন্দ আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানালো, একদিন সে মুম্বাই বেড়াতে যাবে, বলে বিদায় নিল।
এক ঘন্টা পরে ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টের ফোন বেজে উঠলো। ম্যাগেন গিয়ে ফোন রিসিভ করেছে, আমি শুনছি, ম্যাগেন বলছে, “রিটা? হ্যাঁ আছে, ধরো দিচ্ছি”। ম্যাগেন আমায় বলল, একজন কাস্টমার তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।
আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ আমতা আমতা করে বলতে লাগলো, “আমি জর্জ, এক ঘন্টা আগে এসেছিলাম। তুমি আমার ফোন এক্টিভেট করে দিয়েছো”।
আমি ভয় পেয়ে গেছি, কোন ভুল ভাল কিছু হলো কিনা!
“না, কিছুই ভুল হয়নি, মানে ফোন খুব ভাল কাজ করছে। তোমার ব্যবহারে আমি অনেক খুশি। ইয়ে, মানে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কিছু মনে করো না। তুমি কি বিবাহিত?
আমি থতমত খাওয়ার চেয়েও অবাক হয়ে গেছি! আমার ভেতরে যে দাম্ভিক মেয়েটি বাস করে, সেই মেয়েটিই যেন মনে মনে বলে উঠলো, বেটা হোটেলের দারোয়ান এন্ড জেনিটার আমায় জিজ্ঞেস করছে, আমি বিবাহিত কিনা! বিবাহিত নাহলে সে আমায় লাঞ্চে নিয়ে যেতে চাইবে!
সারা গা চিড়বিড়িয়ে উঠলেও ফোনে বললাম, “আমি বিবাহিত। কেন, কোন হেল্প লাগবে?”
-না মানে ইয়ে, তোমার আঙ্গুলে আংটি দেখিনি তো। তুমি কি সত্যিই বিবাহিত?
-আমি বিবাহিত। থ্যাংক ইউ, হ্যাভ এ নাইস ডে”—বলে ফোন রেখে দিলাম।
গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো। না এই কথাটিই যদি বারাক ওবামা জিজ্ঞেস করতো, তাহলে কিন্তু গা চিড়বিড় করার বদলে খুশির চোটে লাফালাফি করতাম। যেহেতু একটা হোটেলের কেয়ারটেকার বলেছে, মেজাজ গরম হয়ে গেছে। আমি তো আর শিল্পী সিনেমার সুচিত্রা সেন নই যে কুমোর-কামার উত্তমের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে মরে যাব!
আমার মুখের চেহারা দেখে ম্যাগেন ভাবলো, বোধ হয় ফোনের ব্যাপারে কিছু ঘাপলামি করছিল বেটা। জানতে চাইলো, কি বলেছে সে? হেসে হেসেই বললাম সব, ম্যাগেন শুনলো, অর্লেন্ডো শুনলো। ম্যাগেন হা হা হাসছে, অর্লেন্ডো তার বিশাল শরীর দুলিয়ে হাসছে। এমন ঘটনা তারা এর আগে এই ডিপার্টমেন্টে ঘটেছে বলে শোনেনি।
অর্লেন্ডো আর আমি, দুজনেই একই সময় ওয়ালমার্টে যোগ দিয়েছিলাম। আমরা খুব ভাল বন্ধু। বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় অর্লেন্ডোর সাথে শেয়ার করি। অর্লেন্ডো জানে, আমি মিসিসিপির অনেক আও-বাও বুঝি না, জানিও না। মিসিসিপির কালো মানুষ আর সাদা মানুষের গল্পের বিষয় আলাদা, খানা আলাদা , সাজ আলাদা, রুচিও আলাদা। অর্লেন্ডো নিজে কালো হলেও প্রেমানন্দ টাইপ নয়। সে অনেকটাই বন্ধু এবং ভাইয়ের মত।
হাসি থামিয়ে অর্লেন্ডো বলল, “এই ধরণের কল এলে ফোন আমার কাছে দিয়ে দিও, যা বলার আমি বলে দেব। তবে, এই ব্যাপারটা তুমি তোমার হাজব্যান্ডের সাথে শেয়ার করোনা। হাজব্যান্ডরা কিন্তু জেলাস হয়। ”
আমি বললাম, “আমার হাজব্যান্ড জেলাস হওয়ার মত মানুষ নয়। তাকে এই ঘটনার কথা বললেও সে এই নিয়ে উতলা হবে না। কারণ প্রথমতঃ আমাদের দেশে আমার বয়সী একজন মহিলার দিকে কোনো পুরুষ ফিরে তাকাবে না, দ্বিতীয়তঃ আমার গায়ের রঙ, আমার মত সাধারণ চেহারার কোনো তরুণীর দিকেও ছেলেরা তাকায় না। কাজেই, ওয়ালমার্টে এ পর্যন্ত যত মজার ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে, আমার হাজব্যান্ড বিশ্বাস করবেনা।
-কী বলছো? রিয়েলি??
-হ্যাঁ, রিয়েলি! এমনকি আমি যদি সত্যি সত্যি কারো সাথে ডেট করতে যাই, আমার হাজব্যান্ড একটুও উতলা হবেনা। কারণ শত হলেও তার মনেও সেই দেশি সেন্টিমেন্ট রয়ে গেছে তো। সে ভাবে, এই বুড়ি মহিলার সাথে কে প্রেম করতে চাইবে? হা হা হা হা!!
-নো নো, এটা ঠিক নয়। তুমি এখনও অনেক অ্যাট্রাকটিভ, তোমার হাজব্যান্ডের উচিত তোমার দিকে চোখ রাখা! হা হা হা হা