ফয়সল আহমদ রুহেল : শৈশবে উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন। উপযুক্ত অভিভাবক কেউ ছিল না। ফলে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। দুরন্ত বেপরোয়া জীবনযাপনের অধিকারী সেই আসাদুজ্জামান এক সময় নিজেকে বদলে ফেলেন। জীবনকে সুশিক্ষায় বিকশিত করেন তিনি। শিক্ষকতা জীবনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। যার ফলে অনেকের বিরাগভাজন হয়ে উঠেন।
জন্ম : আসাদুজ্জামান ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা উপজেলার বীর দক্ষিণ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মৃত আশরাফ আলী ও মাতা রাবেয়া বেগম। ৪ বোন ও ১ ভাই এর মধ্যে আসাদুজ্জামান সবার ছোট।
শিক্ষাজীবন : আসাদুজ্জামান ১৯৬৫ সালে নিজ গ্রামের সেলবরষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে বাদশাগঞ্জ হাইস্কুল থেকে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মানবিক শাখা থেকে তৃতীয় বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৮৫ সনে ঢাকা সিটি কলেজ ভর্তি হয়ে ১৯৮৭ সনে ঢাকা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন এবং ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৃতীয় বিভাগে বি.এ পাশ করেন। ১৯৯০-৯১ সনে ঢাকা শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে বি.পি.এড শেষ করেন।
শৈশব : আসাদুজ্জামান ১৯৬৫ সালে নিজ গ্রামের সেলবরষ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। ১৯৭০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে বাদশাগঞ্জ হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের পরপরই দেশের যে অবস্থা হয় তার সাথে তিনি ছন্নছাড়া হয়ে যান। উপযুক্ত অভিভাবক ছাড়া দুরন্ত বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে লেখাপড়া ভালো করতে পারেননি।
কর্মজীবন : তিনি ঢাকা শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে বি.পি.এড সম্পন্ন করে বাদশাগঞ্জ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার উদ্দেশ্য গ্রামে চলে আসেন। পদটি শুন্য না হওয়া পর্যন্ত ১৯৯১-৯২ পার্শ্বের উপজেলায় শ্যামপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে এক বছর চাকরি করে ১৯৯৩ সনের জানুয়ারিতে বাদশাগঞ্জ হাইস্কুলে শারিরীক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।শারিরীক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেও সমাজ বিজ্ঞান ও বাংলা নিয়মিত পাঠ দান করেছেন গুনী এই শিক্ষক ।বর্তমানে বিদ্যালয়টি সদ্য সরকারিকরন করা হয়েছে। ১৯৯২ সাল হতে মোট ২৯ বছর এক নাগারে চাকরি করে ২০২০ সালের ৩০শে অক্টোবর অবসর গ্রহন করে অনন্ত জীবনের অপেক্ষায় আছেন।
শিক্ষকতা জীবনের স্মরণীয় ঘটনা : শৈশব, শিক্ষা ও কর্ম জীবন আমাদের জীবনে স্মরনীয় অধ্যায়। বিদ্যালয়ে কাটানো প্রতিটি দিনই আমাদের কাছে স্মরণীয়। কিন্তু কর্মজীবনে কাটানো এমন কিছু কিছু দিন থাকে যা কখনো ভোলার নয়। শ্রদ্ধেয় গুণী শিক্ষক আসাদুজ্জামান শিক্ষকতা জীবনের তেমনই দু’একটি দিনের স্মৃতি তুলে ধরেন-
ক) বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা চলছে। ছাত্র হাজিরায় স্বাক্ষর নিচ্ছি। ৭ম শ্রেণীর এক ছাত্র হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করছে না আমি দুয়েক বার তাগাদা দিয়ে খাতায় স্বাক্ষর করছি। এমন সময় অন্যছাত্ররা হাসাহাসি করছে।কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই ছাত্ররা বলছে, স্যার প্রতিদিন স্যারেরা তার নাম লিখে দেয়। আমি জানার পরে, চারপাঁচ পাতা কাগজ নিয়ে রোল করে তার নাম লিখে বলি, তোমার পরীক্ষার দরকার নেই নামটি লিখতে থাকো। লিখতে লিখতে ভালো করে শিখিয়ে দিলাম, আর ভাবছিলাম এটা কি করে হয়, এতোগুলো বছর পেরিয়ে কিভাবে সপ্তম শ্রেণিতে আসলো? অফিসে গিয়ে জানলাম, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে এসে ভর্তি হয়। যাই হউক আমি একটি ছেলের নামটি লিখতে শিখালাম, এই নিয়ে আমি মনে মনে গর্ববোধ করছিলাম।
খ) ২০০০ সালে স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান আমার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে উঠেন। কারন তার দুর্নীতির বিরোধিতা করি। তাই আমার টাইম স্কেল বন্ধ করে দেয়। তাই জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে আবেদন করাতে আরো ক্ষেপে গিয়ে আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করে। আমি শিক্ষাবোর্ডে মামলা দায়ের করি। তিন মাস পরে আর্বেটারি বোর্ডে শুনানীর ডাক পড়ে। যথা সময়ে হাজির হলে শুরু হয় জবানবন্দি ১১ সদস্য বিশিষ্ট আর্বেটরিবোর্ড।
প্রথমেই শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আমাকে জিজ্ঞেস করেন কি কারণে বরখাস্ত করা হয় ? আমি উত্তরে বললাম জানিনা কি কারণ। তখন প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেন। প্রধান শিক্ষক উত্তরে বলেন, আমি কিছুই জানিনা। আগের দিন যোগদান করলাম আর পরের দিন স্কুল কমিটি আমার সামনে কাগজ দিয়ে বলে বরখাস্ত করার জন্যে।
শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আর বিষ্মিত হয়ে যান, কি অবাক কান্ড আপনি প্রধান শিক্ষক হয়ে আগের দিন যোগদান করে পরেরদিন একজন সহকারিকে বরখাস্ত করে ফেললেন, রীতিমত আষ্টম আশ্চর্য। শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।
জিজ্ঞেস করলেন স্কুল চেয়ারম্যানকে কি কারণে বরখাস্ত করলেন? উত্তর আসলো ৭৮ ধারায় প্রধান শিক্ষককে অমান্য করা।তাতে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধিক রাগান্বিত হয়ে বললেন আপনি ধারার কি বুঝেন ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? জানি পারবেন না। কতোটুকু শিক্ষিত আপনি, আমি সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলাম দশ বছর।যাক বলে কথা ঘুরিয়ে বললেন,অন্যকারন থাকলে বলেন,তখন শুরু হলো মিথ্যার বেসাতি।আমি ছাত্রাবাসের সামনে গরু জবাই করি এই নিয়ে বিদ্যালয়ে হিন্দু মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, অভিযোগ শুনে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আমাকে জিজ্ঞেস করেন।
আমি বিষ্মিত হয়ে যাই এতো মিথ্যা কল্পকাহিনী মানুষ বলতে পারে? আমি প্রথমে বলি স্যার আমার বিদ্যালয়ের কল্পনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথাই বলি। আপনি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, আপনার কাছে মিথ্যা ডাটা দিলে সহজেই ধরে নিতে পারবেন। আমার বিদ্যালয়ে ৮৫৬ জন ছাত্রছাত্রী এর মধ্যে মাত্র ১৫ জন হিন্দু ছাত্রছাত্রী। ৮৪১ বনাম ১৫ জনে দাঙ্গার কাহিনী কতো বড় কল্পকাহিনী বিবেচনা করুন। এই কথায় স্কুলের চেয়ারম্যান সবার তোপের মুখে পরে যায়। অভিজ্ঞতা হলো মিথ্যা জয়লাভ করতে পারে না।
পারিবারিক : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আসাদুজ্জামান পারিবারিক জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ে: রাফিসা জামান মৌ- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে এমপিএ। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। ছেলে: রেদোয়ান আশরাফ ফুয়াদ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসীতে অধ্যয়নরত।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ধর্মপাশা উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৫৮৩ বার