উপহারের ফাঁদে বাংলাদেশের নারীরা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রেমের ছলনায় ‘উপহার’ দেওয়ার কথা বলে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এ টাকা লেনদেন হচ্ছে ব্যাংক একাউন্টে। এরা নিজেদেকে আমেরিকার বা ইউরোপের নাগরিক বলে পরিচয় দিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। পরিচয় দেয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বলে। প্রেমে পড়া নারীকে প্রস্তাব দেয় দামি উপহার— ডলার, হিরার আংটি, গহনা ইত্যাদি দেওয়ার। আর উপহার পাঠানোর কথা বলে কুরিয়ারে অথবা বন্দরের মাধ্যমে। পরবর্তীতে উপহার পাঠানো কার্টন ছাড়াবার জন্য নির্ধারিত ব্যাংক একাউন্টে টাকা দিতে বলা হয়। এমনই একটি চক্র এক নারীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। চল্লিশোর্ধ উপজাতীয় নারী সাধনা (ছদ্মনাম)। উচ্চ শিক্ষিত সাধনা একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। স্বামীও চাকরিজীবী। এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। রাজধানীর মহাখালীতে রয়েছে তার নিজস্ব ফ্লাট। গত ৪ এপ্রিল তিনি তার অভিযোগের কথা জানাতে গিয়েছিলেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মশিউর রহমানের দফতরে। এ প্রতিবেদকের সামনে তিনি কথা বলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
ঘটনা সম্পর্কে সাধনা বলেন, গত বছর ফেসবুকে এক ইউরোপীয় লোকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে ঐ বিদেশি জানিয়েছিলেন, তিনি বিয়েসাদি করেননি। ইউরোপ প্রবাসী একাধিক বাঙালি নারীর সঙ্গে তার পরিচয় আছে। তাদেরকে দেখেই তিনি বাংলাদেশের মেয়েদের খুব পছন্দ করেন। এ কারণে সাধনাকে তার ভালো লেগেছে। ধীরে ধীরে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। ফেসবুকে দেওয়া ছবি দেখে বোঝা যায় তিনি সুদর্শন পুরুষ। পরিচয় হবার পর থেকে সাধনা অফিস, বাসা যেখানেই যান সেখানেই চলতো চ্যাটিং। বলতে গেলে দিনে ১৮ ঘণ্টাই যোগাযোগ ছিল। পরে মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথাবার্তা হতো। এ অবস্থা চলতে থাকে আরও কয়েম মাস। প্রতিদিন মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে এতোটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যা কাউকে বোঝাতেও পারছিলেন না সাধনা। এমনকি স্বামী-সন্তানদের প্রতি তার কোনো ধরনের খেয়াল ছিল না। বিদেশি ওই বন্ধু কয়েক দফায় বাংলাদেশেও আসার প্রস্তাব দেন। মনে মনে ঠিক করেছিলেন বাংলাদেশে আসলে ওই বিদেশি বন্ধুর সাথে বিদেশে পাড়ি জমাবেন।
কিন্তু গত বছর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি ওই বিদেশি তাকে জানায়, ব্যবসার জরুরি কাজে তিনি আটকে গেছেন। ফলে নির্ধারিত সময়ে তিনি বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। তবে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন উপলক্ষে তাকে কয়েক হাজার ডলার ও ডায়মন্ড, হিরার অলঙ্কারসহ বেশ কিছু উপহার পাঠাচ্ছেন। আর এ উপহার বাংলাদেশে পৌঁছার পর বাংলাদেশেরই কেউ তার (সাধনা) সঙ্গে যোগাযোগ করবে। অপেক্ষায় থাকেন সাধনা। এরই মধ্যে বাংলাদেশি এক নারী ফোনে তাকে জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে তার বিশাল কার্টনে উপহার পৌঁছে গেছে। তবে এ জন্য কাস্টমসকে ট্যাক্স দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা। ওই মহিলার কাছে সাধনা জানতে চান কীভাবে টাকা পৌঁছাবেন। তখন ওই মহিলা সাধনাকে বেসরকারি একটি ব্যাংকের একাউন্ট নম্বর পাঠায়। তিনি ওইদিনই নির্ধারিত ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ৫০ হাজার টাকা জমা করেন সাধনা। এরপর ব্যাংক একাউন্টধারী ওই মহিলা তাকে জানান, খুব দ্রুতই উপহারের কার্টনটা তার কাছে পৌঁছে যাবে। দুইদিন পর ওই মহিলা ফোনে সাধনাকে জানান, সবই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আরো বেশি ট্যাক্স দাবি করেছে। আরও টাকা দরকার। ওই মহিলার কথা মতো এবার তিন লাখ টাকা পাঠান আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের একাউন্ট নম্বরে। ওই দিনই বিদেশি বন্ধু ফোনে সাধনার কাছে জানতে চায়, উপহার পেয়েছেন কিনা। তিন লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর আরো কয়েকদিন কেটে যায়। এবার ওই মহিলা ফোনে জানান, কার্টনে কয়েক হাজার ডলার, ডায়মন্ড, হিরার গহনা থাকায় কাস্টমস আরো ৫ লাখ টাকা দাবি করেছে। কিন্তু তৃতীয় দফায় আবার টাকা চাওয়ায় সাধনার সন্দেহ হয়। পরে তিনি ওই দুই ব্যাংক একটাউন্টে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, টাকা জমা হবার পরপরই মিরপুর ও পল্লবী শাখা থেকে সঙ্গে সঙ্গে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ অবস্থায় তিনি ব্যাংক একাউন্টের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নেন। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একাউন্টধারীর কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। সাধনা তার বিদেশি বন্ধুকেও বিস্তারিত অবহিত করে। এক পর্যায় তার বিদেশি বন্ধুও দ্রুত ৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার তাগিদ দেন। তখন সাধনা তার আত্মীয় পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে ডিসিডিবির (উত্তর) সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এডিসি (ডিবি) নিশাদ রহমান মিথুনকে তদন্তের নির্দেশ দেন। ডিসিডিবি মশিউর রহমানের প্রশ্নের জবাবে সাধনা বলেন, ‘আমি বিদেশির বন্ধুর কথায় এতেটাই মোহবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম, যে তিনি যদি আত্মহত্যার কথা বলতেন, তবে তাই করতাম’। এ ব্যাপারে এডিসি নিশাদ রহমান মিথুন বলেন, দুই ব্যাংকের একাউন্টধারী একই মহিলা। ওই মহিলার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কয়েকজন নাইজেরীয় নাগরিক যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তারা বিদেশি বন্ধু সেজে বিভিন্ন নারীকে প্রেম নিবেদন করে থাকে। এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরো বলেন, চক্রটি আরো কিছু নারীর সঙ্গে প্রেম নিবেদন করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে।