ঋতুপর্ণ ঘোষ সৃজনশীল মানুষ-
মহী জামান (ফেসবুক থেকে সংগৃহিত) -আজ ৩১ আগষ্ট। ঋতুপর্ণ ঘোষ এর জন্ম দিন। ১৯৬৩ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতায় ঋতুপর্ণার জন্ম। ঋতুপর্ণ ঘোষ কে অনেকের জানা। অবাক করা তার সৃষ্টিশীল প্রতিভার কথাও অনেকের জানেন। তিনি ছিলেন ভারতের বাঙালি চিত্র পরিচালকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, আলোচিত ও বিতর্কিত একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। বাঙালির মনোজগতকে সেলুলয়েডে বন্দী করে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে নতুন করে বাংলা ছবি তিনিই পরিচিত করেছিলেন। প্রচলিত কিংবা চালু ধ্যান ধারণাগুলোকে তিনি ভেঙেচুরে নিজের আঙ্গিকে অনন্য এক মাত্রা যোগ করেছিলেন
ব্যক্তিগত জীবনে ঋতুপর্ণের পরিচয় নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিলো। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘লিঙ্গ’ নিয়ে অনেকের ভিন্ন ধারনা বিতর্কের জন্ম দেয়। তাকে নিয়ে ছিলো খুব ক্লিষে বিতর্ক। ঋতুপর্ণ ঘোষ কী পুরুষ ছিলন নাকি নারী? নাকি দুটোই ছিলেন? না হিজড়ে ছিলেন? সমকামী না ট্রান্সজেন্ডার। নাকি পুরুষ থেকে রুপান্তরিত নারী ছিলেন? এ নিয়ে অনেকের অনেক মত ছিলো। যার যা খুশী তারা আই বলতেন। মন্তব্য করতেন। মানবতাবাদীরা ঋতুপর্ণাকে সমকামী, রুপান্তরকামী, হিজড়ে, নারী, পুরুষ এর কোনটিই মনে করতেন না। তার ভাবতেন তিনি ছিলেন একজন মানুষ। শুধু মানুষ।
মানবতাবাদীদের মতে ঋতুপর্ণার পরিচয় বিতর্ক হচ্ছে সমাজের নিতান্ত ইতর, অসভ্য ও অমানবিক কাজ। এখানে মানুষের মূল্য নেই, নেই মানবিকতার মূল্য। এখানে মানুষের চেয়ে ‘লিঙ্গ’ বড় ও প্রধান হয়ে উঠে। একটি মানবশিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই, বেরিয়ে আসতে না আসতেই, অস্থির চোখের দৃষ্টি উপুড় হয়ে পড়ে, রীতিমতো হামলা করে দেখতে, শিশুটি নারী নাকি পুরুষ! শিশুটির ‘লিঙ্গ’ কী? পুরুষ হলে উৎসব, নারী হলে বিষাদ! আর নারী পুরুষ না হলে অভিশাপ।
ঋতুপর্ণার আবরণ ও আভরণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ঋতুপর্ণ ‘ইউনিসেক্স’ পোশাক পড়তেন। যেটি কামিজ, সালোয়ার নয়। প্যান্ট শার্ট নয়। আবার পাঞ্জাবি, পাজামাও বলা যায় না। যেটি পোষাক ছিলো একান্তভাবেই ‘ঋতু পর্ণার পোশাক’। যা কেবল তাকে মানায়। তার পরিচিতদের অনেকে তাকে পুরুষ পরিচয়ে দাদা বলে ডাকতেন। নারী হতে তিনি বেশ চেষ্টা করলেও কেউ তাকে দিদি বলে ডাকতেন না।
ঋতুপর্ণ ঘোষ কোলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ে পাঠকালীন সময় কর্মজীবন শুরু করেন। শুরু ছিলো একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে। ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ছবি ‘হিরের আংটি’। দ্বিতীয় ছবি ‘উনিশে এপ্রিল’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। এই ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। দুই দশকের তার কর্মজীবনে তিনি ১৯টি চলচ্চিত্রের নির্মান করেছেন। এরমধ্যে ১২টিতে পেয়েছেন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরষ্কার। পেয়েছেন বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার।
ঋতুপর্ণার তৈরী উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি ‘শুভ মহরত’ (২০০৩), ‘রেইনকোট’ (২০০৪), ‘অন্তরমহল’ (২০০৫), ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ (২০০৭), ‘খেলা’ (২০০৮), ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৮), ‘আবহমান’ (২০০৯), ‘নৌকাডুবি’ (২০১০), ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ (২০১১), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (২০১২), ‘জীবনস্মৃতি’ (২০১২) এ সব ছবি পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে কিংবদন্তি পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ ১০ বছর ধরে ডায়াবেটিসে এবং ৫ বছর ধরে প্যানক্রিয়াটিস রোগে ভুগছিলেন। প্রায় সারা জীবন তিনি ভয়াবহ অনিদ্রা রোগে ভুগেছেন। সে জন্য তিনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। অবশেষে ২০১৩ সালের ৩০ মে কলকাতার বাড়িতেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।