হাসান হামিদ–

কবি শামসুর রাহমান অনেক দিন আগে ঢাকা নিয়ে ‘এ-শহর’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতায় তিনি ঢাকা শহরের যে দুঃসহ বাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন তা এখনো এ নগরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য:
“এ-শহর ট্যুরিস্টের কাছে পাতে শীর্ণ হাত যখন তখন;
এ-শহর তালি মারা জামা পায়ে, নগ্ন হাঁটে খোঁড়ায় ভীষণ।
এ-শহর রেস খেলে, তাড়ি গেলে হাঁড়ি হাঁড়ি, ছায়ার গহ্বরে
পা মেলে রগড় করে আত্মার উনুনের কাছে, ঝাড়ে ছারপোকা”।

আমরা যারা ঢাকায় থাকি তারা পথে ঘাটে কতভাবে অস্বস্তিতে পাশ কাটাই তা সবাই কমবেশি জানি। তবে আশার কথা হলো ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে একটি ‘স্মার্ট শহরে’ পরিণত করতে করণীয় কী, তা নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে কয়েক দিন আগে।  বিশ্ব ব্যাংক বলছে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বাস করা মানুষের ৩৬ ভাগই বাস করে ঢাকায়। আর বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি।  কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই শহরটি গড়ে উঠার ফল হিসেবে ঢাকা পরিণত হয়েছে বসবাসের ক্ষেত্রে নিম্ন মানের শহরে আর বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ভয়াবহ যানজটে।  বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব মতে, গত ১০ বছরে সড়কে যান চলাচলের গতি ঘন্টায় গড়ে ২১ কিলোমিটার থেকে কমে এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৭ কিলোমিটারে, মানুষের গড় হাঁটার গতির চেয়ে একটু বেশি। যানজট, জলাবদ্ধতার মতো সঙ্কটের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণেও ঢাকায় বেড়েছে ভূমিকম্প ও বন্যার ঝুঁকি। ৩৫ লাখ বস্তিবাসী প্রায়শই বঞ্চিত হচ্ছে ন্যূনতম সুবিধা থেকেও।

আমাদের এই ঢাকা শহরের ঐতিহ্য চারশত বছরের অধিক। আগে ছিল পৌরসভা, পরে তা সিটি কর্পোরেশনে পরিণত করা হয়। এখানে বর্তমানে লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। দেশের ধনী, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শিক্ষিত লোকের বেশির ভাগের বাস এখানে। গরিব মানুষের সংখ্যাও অনেক। বিবিএস সূত্রে জেনেছি,  দেশে যত গরিব মানুষ আছে, তার এক-তৃতীয়াংশ বাস করে ঢাকায়। গরিব মানুষের সংখ্যা যেহেতু বেশি, তাই বস্তির সংখ্যা সর্বাধিক। উপরন্তু প্রতিদিনই মানুষ কাজের আশায় ঢাকায় আসছে। এখানে রাস্তাঘাট প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেক। তারও অধিকাংশই আবার ভাঙাচোরা। আবাসন, শিক্ষাঙ্গন ও বিনোদনের সংকট প্রকট। আর বেশ কয়েকটি পার্ক আছে। সেগুলো যানবাহন, মাদকসেবি আর বখাটে লোকে ভরপুর। তাই সাধারণ লোক তেমন যায় না সেখানে। পানি, বিদ্যুৎ পয়ঃনিষ্কাশনের সংকট তীব্রতর। জলাবদ্ধতা, রাস্তা দখল, অপরিকল্পিত ও জরাজীর্ণ বাড়িঘর, ব্যাপক চাঁদাবাজি নিরাপত্তাহীনতা, ভয়াবহ যানজট ইত্যাদি বিদ্যমান। তাই এখন বসবাসের অনুপযোগীর দিক দিয়ে বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। বায়ু দূষণের দিক দিয়েও ঢাকা প্রথম। কিন্তু কেন? সব দলের নেতা-নেত্রী, এমপি, মেয়র, মন্ত্রী-আমলারা তথা নামিদামি সকলেই তিলোত্তমা ঢাকা গড়ার কথা বলেন অহরহ। আর নির্বাচন এলে তো কথাই নেই। সকলেই বিশ্বের সেরা শহরে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেন। ঢাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য প্রধানত দায়ী সিস্টেম। মেয়র-কাউন্সিলরদের কাছে সুন্দর ঢাকা গড়ে তোলার প্রত্যাশা ঢাকাবাসীর। কিন্তু তাদের এখতিয়ার নগণ্য তাই মেয়রদের ভালো কিছু করার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা করতে পারে না।

ঢাকার যেখানেই যাবেন সেখানেই দেখতে পাবেন আবর্জনার স্তূপ। আবর্জনা রাখার কনটেইনারগুলোর অবস্থাও করুণ। অনেক ক্ষেত্রে ব্যস্ততম রাস্তার মাঝখানেই বসানো হয়েছে। কিন্তু আবর্জনা রাখা হয় কনটেইনারের ভেতরের চেয়ে বাইরেই বেশি। সেগুলো সরানো হয় না সহসায়। ফলে আবর্জনাগুলো রাস্তাজুড়েই পড়ে থাকে। এসব পচে-গলে রস নিংড়ে পড়ে সমগ্র রাস্তায়। ফলে সৃষ্টি হয় মহাদুর্গন্ধ। কয়েক দিন পরপর কনটেইনারগুলোর ময়লা নিয়ে ফেলা হয় শহরের যেখানেই ফাঁকা পাওয়া যায় সেখানেই। তাই সৌন্দর্য ও পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তা থেকে অনবরত নির্গত গন্ধে মানুষের বিভিন্ন জটিল ও স্থায়ী ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে। মশামাছির বিস্তার ঘটছে ব্যাপক। উপরন্তু এই ময়লার অনেক অংশ ড্রেনের মধ্যে ঢুকে পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে দূষিত পানি নিষ্কাশন হতে না পেরে রাস্তার ওপরই উপচে পড়ছে। সর্বোপরি বৃষ্টি হলেই পানি দ্রুত যেতে না পেরে গোটা শহর অথৈ পানিতে তলিয়ে যায়। তবুও ময়লা ও ড্রেন পরিষ্কার করার কাজটি নিয়মিতভাবে হচ্ছে না। অথচ এসব কাজ নিয়মিত করার বিধান আছে।

এবার অনেক বছর পর এবার সুয়ারেজ লাইন বা ড্রেন পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। কিন্তু তার সুফল তেমন পাওয়া যায়নি। কারণ ড্রেনের ভেতরের ময়লা তুলে পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। ফলে ময়লাগুলো মানুষের পায়ে পায়ে আর যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে পুনরায় ড্রেনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ড্রেন বন্ধ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ, যত্রতত্র গড়ে ওঠা তরকারির দোকানের বর্জ্য ও নির্মাণ সামগ্রী তথা বালি, সিমেন্ট ও ইটের ভগ্নাংশ। এগুলো ড্রেনের মধ্যে ঢুকে পড়ায় বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এগুলো রাস্তার ধারে রাখা নিষিদ্ধ। কিন্তু নিয়ম পালন করেন না কেউই। অপরদিকে প্রতিটি বাসার ময়লা নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বেসরকারি খাতে। এ জন্য তারা প্রতি মাসেই টাকাও নেয়। শর্ত প্রতিদিনই ময়লা নিতে হবে। কিন্তু তারা এই শর্ত পালন করে না।

কিছু দিন আগে সব রাস্তার ধারে ময়লা ফেলার বক্স বসানো হয়েছে। এটা একটা খুবই ভালো উদ্যোগ। সব দেশেই এই ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যেই অনেক বক্স ভেঙেচুরে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। বাকিগুলোর বেশির ভাগ বন্ধ করে রেখেছে ক্লিনাররা। যে দু-চারটা খোলা আছে, তা ময়লায় ভর্তি হয়ে থাকে অনেক দিন। কারণ বক্সের ময়লা সরানো হয় না। এ অবস্থায় শুধু ফ্লাইওভার বা ফুটওভারে ফুলের গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার কাজে কি মানুষ খুশি হবে?

একথা সবাই জানি যে, ঢাকায় যানজট ব্যাপক। এতে প্রতিবছর ২-৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন কম হয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। রাস্তা দখলমুক্ত ও হকারমুক্ত করতে পারলেই যানজট অর্ধেক কমে যাবে বলেও তাদের অভিমত। অবশ্য যানজট কমানোর জন্য অনেক ফ্লাইওভার, ফুটওভার ও ইউলুপ নির্মাণ করা হয়েছে, আরো অনেকগুলোর নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া মেট্রোরেল স্থাপনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এসব কাজ শেষ হলে যানজট কিছুটা কমবে। কিন্তু শেষ হবে না। তাই রাস্তা দখল ও হকারমুক্ত করা আবশ্যক।
ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং ও স্থাপনা ভেঙে ফেলার জন্য বহুবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সবই বহাল আছে। আর সেখানেই অসংখ্য মানুষ বসবাস করছে। কিন্তু ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডির মতো অবস্থা সৃষ্টি হবে নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অবস্থা ভয়াবহ হবে আরো বেশি। তাই এই সংকট নিরসন না করে সব বাড়ি ফ্ল্যাট রং করার সিদ্ধান্ত যক্তিযুক্ত কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। যা হোক ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিংয়ের বিষয়ে অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। আমরা সাধারণ জনগণ স্বপ্ন দেখি সুন্দর, স্বপ্নের সমান স্বস্তির এক ঢাকা শহরের। আমাদের স্বপ্ন কি বাস্তবতার সমান্তরালে দাঁড়াবে না কোনোদিন?

লেখক- গবেষক ও সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn