ওয়াজ আর গান মিলেমিশে একাকার
তথ্য প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় মাহফিলের ওয়াজ চলে এসেছে নেটে, অনুষ্ঠানের গণ্ডি ছাড়িয়ে গানও স্থান করে নিয়েছে সেখানেই। একই প্ল্যাটফর্মে থেকে দুইয়ের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়াও নেটিজানদের আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। ফেইসবুক-ইউটিউবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধর্মীয় বক্তা মুফতি মওলানা গিয়াস উদ্দিন তাহেরীর প্রচুর ওয়াজ রয়েছে, যেখানে তাকে গানের সুরে কথা বলতে দেখা গেছে। বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ‘বন্ধু তোর লাইগা রে’ গানের সুরে ‘মুর্শিদ তোর লাইগা রে’ গেয়েছেন তিনি। ‘নিশি রাইতে কার বাঁশি বাজে’, ‘বন্ধুর মালায় বড় জ্বালারে, মালা রাখব না; মালা রাখব না রে’, ‘যদি থাকে নসিবে, আপনি আপনি আসিবে’, ‘আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘কাঁচা বাদাম’সহ বেশ কিছু গানও ওয়াজ মাহফিলে গাইতে দেখা গেছে তাকে। তাহেরীকে ‘মোর দশা কি এমন হয়’ গানের আদলে গাইতে দেখা যায়, ‘আমি ওই চরণের দাসের যোগ্য নই, নইলে মোর দশা কি এমন হয় দয়াল মোর দশা কি এমন হয়’।
হালের হাওয়া সিনেমার ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’র কথা বদলে একই সুরে গান গাইতে দেখা গেছে বিভিন্ন ধর্মীয় বক্তাকে। ওয়াজে গানের ব্যবহারে তাহেরীকেও ছাড়িয়ে গেছেন মওলানা গোলাম রাব্বানী। ‘গুরু গাঞ্জা বানাইলা কী দিয়া-টানে টানে মজা পাই পাই-মাইয়া একখান দেখতে পাই-গুরু গাঞ্জা বানাইলা কী দিয়া’ ওয়াজ মাহফিলে তার গাওয়া ভাইরাল একটি গান। গাইবান্ধার এই ধর্মীয় বক্তা উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন ওয়াজে তিনি ‘বলবো না গো আর কোনো দিন ভালোবাসো তুমি মোরে’, ‘তুমি ভালোবাসা নাই যদি দাও, এই মুখে বিষ ঢেলে প্রাণ কেড়ে নাও’, ‘আমি তো ভালা না ভালা লইয়া থাইকো’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’, ‘সবকিছু ছাড়িয়া তোরা বাবার চরণ ধর, আয়না বসাইয়া দে মোর ক্বলবের ভিতর’, ‘আমি ডুব দিয়াছি প্রেম দরিয়ায় বাবার সন্ধানে’, ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা- তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা,’ ‘দে দে পাল তুলে দে-মাঝি হেলা করিস না-ছেড়ে নৌকা মাঝি যাব মদিনা’, ‘সাধের লাউ বানাইছে মোরে বৈরাগী’সহ তার বেশ কিছু গান রয়েছে সোশাল মিডিয়ায়।
‘আমার মতো এত সুখী নয়ত কারও জীবন’, ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না, ও প্রেম করতে দুইদিন ভাঙতে দুইদিন এমন প্রেম আর কইরো না দরদী’, ‘আমি বারোবাস তোমায় ভালোবাসি তুমি সুযোগ পাইলে বন্ধু আসিও’, ‘তালা খুইলা দে বাশার ভাই তালা খুইলা দে রহমতের চাবি দিয়া তালা খুইলা দে’, ‘মাইয়ারে মাইয়ারে তুই অপরাধী রে, আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরাইয়ারে’ গানগুলো ছাড়াও হিন্দি গান ‘ও লেড়কি আঁখ মারে’র সুরেও গাইতে দেখা গেছে রাব্বানীকে। এছাড়া বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের সুর নিয়ে ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি ধর্মীয় রূপ দিয়ে প্যারোডিও গেয়েছেন তিনি। সুলতানা ইয়াসমিন লায়লার কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘সখী গো আমার মন ভালো না’ গানের প্যারোডি করে গেয়েছেন- ‘আককেলে ছাগল বন্দি জালে বন্দি মাছ-পাপিয়ার মোবাইলে নেতা বন্দি ভিডিও হইলো ফাঁস-সখী গো আমার মন ভালা না।’ ‘পাগল মন মনরে’ গানের সুরে গেয়েছেন ‘আল্লাহরে কোন দুনিয়ায় পাঠাইলা আমারে’, ‘আমার কেমন লেগেছিল’ গানের সুরে গেয়েছেন ‘আমরা আল্লাহর হলে-শয়তানের জ্বলেরে বন্ধু-শয়তানেরই জ্বলে-তুমি নামাজ পড়লে শয়তানেরই জ্বলে।’
ডলি সায়ন্তনীর গাওয়া ৯০ দশকের জনপ্রিয় গান ‘কালিয়ারে কালিয়া’র সুরে ‘পাপিয়ারে পাপিয়া-কী হবে আর কান্দিয়া- ফাঁইসা গেছিস পাপের টাকা কামাই করিয়া’ গাইতে দেখা যায় গোলাম রব্বানীকে। এছাড়াও ‘তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই-আর কিছু জীবনে পাই বা না পাই’, গানের সুরে ‘এই মন চায় শুধু এই প্রাণও চায়, যেতে মোর নবীজির পবিত্র রওজায়’ গেয়েছেন। মাহফিলে বিভিন্ন গানের লাইন গেয়ে তার জবাবও দেন এই বক্তা। ‘মাইয়া ও মাইয়া তুই অপরাধীরে’ গান গেয়ে বলেন, ‘তুই অপরাধী হইহিছ ক্যা?’ ‘আমার ঘুম ভাঙিয়া গেল রে মরার কোকিলে’ গেয়ে গায়িকার উদ্দেশে বলেন, ‘তোমার ঘুম এত পাতলা কেন, মরার কোকিলও ঘুম ভাঙিয়া দেয়?’ মওলানা ইলিয়াসুর রহমান জিহাদীর ওয়াজে গান পরিমাণে কম হলেও তার অঙ্গভঙ্গির কারণে সে সব সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে। আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয় গান ‘আমি বারোবাস তোমায় ভালোবাসি’ তিনি প্যারোডি করে গেয়েছেন- ‘আমি বারোবাস তোমায় ভালোবাসি-তুমি সুযোগ পাইলে গুতা দিও’ আকারে।
‘ওরে ওরে হাওয়া থাম না রে’সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের পাশাপাশি ‘ফাতেমারে দাওয়াত দিল-খাবার সবই পাথর হলো’ জাতীয় জারি গানও গাইতে দেখা গেছে জিহাদীকে। মওলানা মিজানুর রহমান আজহারীকে ‘পরের জায়গা পরের জমি-ঘর বানাইয়া আমি রই’, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘আমি একটা জিন্দা লাশ-কাটিস না রে জঙলার বাঁশ’সহ সিলেটের আঞ্চলিক গান ‘আমরা হক্কল সিলোডি’ গাইতে দেখা গেছে।
ক্বারী আমানুল্লাহ সিদ্দিকী নামের এক ধর্মীয় বক্তার মুখে শোনা যায়, ‘মধু হই হই আঁরে বিষ হাওয়াইলা’, ‘বন্ধু তোর লাইগা রে-আমার তনু জ্বরও জ্বর’, ‘গান গাইছিল খাজা যেইদিন’, ‘মিস জরিনা’, ‘মশারে মশারে তুই অপরাধীরে’, ‘স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসে শুধু আমার মা’, ‘আমি তো সেই ঘরের মালিক নই’সহ বেশ কয়েকটি বাংলা গানের সঙ্গে ‘কিউকি তুমহি তো’, ‘কিতনে পেয়ারি আখি’সহ বেশ নানা হিন্দি গানও গাইতে দেখা গেছে। নাজমুল ইসলাম মোজাহেদীসহ খুব বেশি পরিচিত নন এমন বক্তাও বিভিন্ন মাহফিলে ‘মাঝি বাইয়া যাওরে’, ‘জীবন যৌবন সইপা দিয়া-গলিসা বাবার মন পাইলাম না’, ‘এক বিন্দু ভালোবাসা দাও- আমি এক সিন্দু হৃদয় দেব’, ‘আর কত কতকাল ভাবস বো আমি-দুখের সারি গাইয়া’ গানগুলো গাইতে দেখা গেছে। ধর্মীয় বক্তাদের এসব গান এক করে নানা ভিডিও তৈরি হয়েছে, যেগুলো সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে আছে। ওয়াজের মধ্যে গান নিয়ে আসার জন্য সমালোচনাও হচ্ছে, যার জবাব তাহেরী এক মাহফিলেই দিয়েছেন। তার ভাষ্যে, “যুবকদের গানের আড্ডা থেকে মাহফিলমুখী করার জন্য একটু গান গাই। গাই মূলত তরুণদের ওয়াজের ভক্ত বানানোর লাইগা। দুই ঘণ্টা ওয়াজে মাত্র দুই মিনিট শান গাই, গান গাই। বাকি সময় তো ওয়াজ করি।”
ওয়াজ থেকেও গান
ওয়াজে যেমন গান আসছে, তেমনি ওয়াজে ব্যবহৃত শব্দ নিয়েও গান তৈরি হচ্ছে, যা সোশাল মিডিয়ায় বেশ আলোচিতও হচ্ছে।গিয়াস উদ্দিন তাহেরীর জিকিরের সময় বলা ‘বসেন বসেন-বইসা যান’ লাইন ও জিকিরের সুর ভাইরাল কিছু সংলাপের সঙ্গে মিলিয়ে ইউটিউবার প্রত্যয় হিরণ একটি গান করেছেন। এই গানে সঙ্গ দিতে দেখা যায় তার ‘আজাইরা লিমিটেড’কে। ‘দ্য আজাইরা লিমিটেড’ ইউটিউব চ্যানেলে গানটি ৩ কোটি ৭০ লাখ দেখা হয়েছে। তাহেরীর গাওয়া ‘দয়াল তোর লাইগা রে’ গানের সঙ্গে হিপহপ মিউজিক যোগ করে একটি ডিজে ভার্সন মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে আপলোড দেওয়া হয়েছে ডিএইচ কবির খান নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে। দুই বছর আগে আপরোড দেওয়া ভিডিওর ‘ভিউ’ প্রায় ২৬ কোটি। তাহেরীর সুরে গাওয়া ‘এজি তোর লাইগা রে’ গানের সঙ্গে মিউজিক যোগ করে ডিজে ভার্সন ইউটিউবে মুক্তি দিয়েছেন ডিজে হাসান নামের একজন, যা দুই বছরে ৬ কোটি ২০ লাখ ভিউ হয়েছে। এই বক্তার ‘তোমরা কি বুঝাইবা আমার অন্তর পুইড়া কয়লা’ গানের ডিজে ভার্সনও ইউটিউবে দেখা হয়েছে এক কোটির বেশি বার।