কী ভেবে দল নির্বাচন করেন বাংলাদেশের নির্বাচকেরা
বার্তা ডেস্ক :: নির্বাচক শব্দটির প্রয়োগ দুরকম হতে পারে। এক, যে নির্বাচন করে অর্থাৎ নিজের হাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। দুই, যে ভোট প্রদান করেন অর্থাৎ তার মতামত জানান। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হতে যাচ্ছে সেটা বলা বা নির্ধারণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দুই ধরনের প্রয়োগ নিয়ে অবচেতন মনে একটু নাড়াচাড়া করুন, ততক্ষণে আমরা একটু বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কথা ভেবে নেই। সেটা সচেতন মন নিয়েই। গতকাল আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচের আগে খেলা সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ মত দিচ্ছিলেন বেশ কয়েকজন ক্রীড়া বিশ্লেষক। এর মাঝে এক উপস্থাপিকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন এক বিশ্লেষকের দিকে, ‘বাংলাদেশ দলে তো একটি পরিবর্তন আসছে তাই না?’ অপ্রস্তুত বিশ্লেষক একটু থমকে গিয়ে জানালেন, ‘এটা আসলে আমার জানা নেই।’ টসের সময়ই জানা যাবে জিম্বাবুয়ে ম্যাচের দলে কোনো পরিবর্তন আনছে কিনা দল। বিশ্লেষকের পরিচয় তিনি সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। আরেকটি পরিচয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় নির্বাচনের দায়িত্বও তাঁর।
হাবিবুল বাশারের অকপট স্বীকারোক্তি বেশ লেগেছে। নির্বাচকদের কাজই তো এমন। তারা দলের প্রয়োজন মেনে খেলোয়াড় নির্বাচন করেন বটে কিন্তু মাঠে কোন ১১ জন নামবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব টিম ম্যানেজমেন্টের। সে কাজে নির্বাচকদের হাত দেওয়া অনুচিত। সে ক্ষেত্রে দলের নির্বাচক সফল। দলের নির্বাচক এর আগের দিনই তাঁর মূল দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের চাহিদা মেনে ত্রিদেশীয় সিরিজের দলে বাঁ হাতি পেসার আবু হায়দারকে ডেকে পাঠিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে দুই ম্যাচের জন্য ১৩ জনের দল ঘোষণা করেছিলেন তারা। কিন্তু এক ম্যাচ পরেই প্রতিজ্ঞা ভেঙে নতুন করে আবু হায়দারকে দলে টানার পেছনে নির্দিষ্ট করে কোনো কারণ হাবিবুল বাশার বলেননি। সেটা জানা গেছে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনের বরাতে। ১৩ জনের দলে থাকা কখনো টি-টোয়েন্টি না খেলা তরুণ পেসার ইয়াসিন আরাফাত চোটে পড়েছেন তাই তৃতীয় পেসার হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আবু হায়দারকে। যদিও ম্যাচের একাদশে সুযোগ না দেওয়ায় এভাবে তড়িঘড়ি করে তাঁকে দলে টানার পক্ষে যুক্তি পাওয়া যায়নি।
গতকাল টুর্নামেন্টের প্রথম দুই ম্যাচ শেষ হয়েছে। দলে পরিবর্তন আসবে, এটা জানা ছিল। নির্বাচকেরা এবার কথা রেখেছেন। চোটে পড়ায় ইয়াসিনকে বাদ দেওয়া হয়েছে গ্রুপ পর্বের বাকি দুই ম্যাচ থেকে। আন্তর্জাতিক অভিষেকের স্বপ্নটা আপাতত পিছিয়ে পড়েছে এই পেসারের। কিন্তু দল থেকে স্পিনার মেহেদী হাসানের বাদ পড়ার ব্যাখ্যা কী? চোটে যে পড়েননি সেটা কাল ম্যাচের একপর্যায়ে টাওয়েল ও পানি বহন করে প্রমাণ দিয়েছেন মেহেদী। ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে, বাংলাদেশ এমনিতেই ফিঙ্গার স্পিনারের অভাব নেই। মাহমুদউল্লাহ, মোসাদ্দেকের উপস্থিতিতে আফিফের হাতেই বল উঠছে না। সেখানে ব্যাটিং দক্ষতায় এ তিনজনের চেয়ে পিছিয়ে থাকা মেহেদীকে টি-টোয়েন্টি দলে আপাতত আর দরকার হচ্ছে না। কিন্তু মেহেদী যে একজন ফিঙ্গার স্পিনার এবং দলে যে আরও তিনজন ফিঙ্গার স্পিনার আছে সেটা দুই ম্যাচ চলে যাওয়ার পরই প্রথম টের পেলেন নির্বাচকেরা? আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার জন্য এর মাঝেই ১৯ জন ক্রিকেটারকে ডেকে পাঠিয়েছেন নির্বাচকেরা। হাতে আরও দুই ম্যাচ বাকি। সবকিছু ঠিক থাকলে ফাইনালসহ তিন ম্যাচ। ফলে নতুন করে কাউকে ডাকার সম্ভাবনাও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে আরেকটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা যাক। জরুরি ভিত্তিতে দলে ডাকা হয়েছিল আবু হায়দারকে। ১৪ তারিখ দলের সঙ্গে অনুশীলন করানো হয়েছিল তাঁকে। তারপরই তাঁকে দলে ডাকার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ডেকে আনার পেছনে প্রাথমিক দলের অনুশীলনের পারফরম্যান্স আর সেখান থেকে দলে ডাক পাওয়ার পেছনে পরশুর অনুশীলনই নিশ্চয় সে ক্ষেত্রে মাপকাঠি ছিল। দলে ডাক পাওয়ার পর আর অনুশীলনের সুযোগ মেলেনি দলের কিংবা আবু হায়দারের। কাল দুই পেসার নিয়ে নামায় একাদশেও সুযোগ মেলেনি। ম্যাচ শেষ হতে না হতেই নির্বাচকদের মনে হয়েছে এই বাঁহাতি পেসারকে আর দরকার হচ্ছে না তাঁদের! কোনো ম্যাচ না খেলে বাদ পড়ায় যদি মেহেদীর আক্ষেপ থাকে, সে ক্ষেত্রে দলে নাম ঘোষণা হওয়ার পর নতুন কোনো অনুশীলন সেশন কাটানোর আগেই বাদ পড়ার পর আবু হায়দারের অনুভূতি এখন কেমন?
আজ নতুন করে বাংলাদেশ দল ঘোষণা করেছেন নির্বাচকেরা। কোনো ম্যাচ না খেলেই যোগ্যতা কিংবা অযোগ্যতার ছাপ না ফেলেই বাদ পড়েছেন মেহেদী, ইয়াসিন ও আবু হায়দার। তাঁদের সঙ্গে বাদ পড়েছেন ব্যর্থ সৌম্য সরকার। আর বড় এক রদবদলের ডাক দিয়ে পাঁচজন ক্রিকেটারকে ডেকে আনা হয়েছে বাকি দুই ম্যাচের জন্য। ইয়াসিন ও আবু হায়দারের বদলি হিসেবে ঢুকেছেন অভিজ্ঞ দুই পেসার রুবেল হোসেন ও শফিউল ইসলাম। সৌম্যের পরিবর্তে এসেছেন দুই বাঁহাতি ওপেনার নাজমুল হোসেন শান্ত ও নাঈম শেখ। এর মাঝে নাজমুল বহুদিন ধরে জাতীয় দলের আশপাশে আছেন। টেস্ট ও ওয়ানডেও খেলে ফেলেছেন। ওদিকে গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ৮০৭ রান করা নাঈমকে নিয়ে আশায় আছেন সবাই। এঁদের সঙ্গে চমক হিসেবে আছেন আমিনুল বিপ্লব। আমিনুল বিপ্লবকে প্রথমে মেহেদির বদলি হিসেবেই ভাবা হচ্ছিল। ফতুল্লায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচে (০/৩৭) খেলেছেন। ফিঙ্গার স্পিনার ভর্তি এক দলে আমিনুলের মতো লেগ স্পিনারের অন্তর্ভুক্তিও আশাজাগানিয়া। ঝামেলাটা অন্যখানে। লেগ স্পিন করতে জানলেও আমিনুলের মূল পরিচয় তিনি একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। লিস্ট ‘এ’তে ১৯ ম্যাচে ৩ উইকেট এবং দুটি টি-টোয়েন্টি খেলে বল হাতে না নেওয়া সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে। জাতীয় দলে একজন লেগ স্পিনার দরকার। তাই হয়তো ঘরোয়া ক্রিকেট কিংবা ইমার্জিং দলের হয়েও বল হাতে কিছু করে দেখাতে না পারা একজনকে ডেকে এনে আসলেই চমকে দিয়েছেন নির্বাচকেরা। কথা হচ্ছে, তাঁকে ম্যাচের একাদশে রাখার সাহস কি দল দেখাবে?
আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার জন্য এর মাঝেই ১৯ জন ক্রিকেটারকে ডেকে পাঠিয়েছেন নির্বাচকেরা। হাতে আরও দুই ম্যাচ বাকি। সবকিছু ঠিক থাকলে ফাইনালসহ তিন ম্যাচ। ফলে নতুন করে ডাকাডাকির ভাবনাও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচকদের এমন অস্থিরতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে শ্রদ্ধাভাজন সাবেক জাতীয় কোচ ও ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব জালাল আহমেদ চৌধুরী, ‘মহীন্দর অমরনাথ এক সময় ভারতীয় ক্রিকেটারদের “বাঞ্চ অব জোকার” বলেছিলেন। কথাটা সে সময় গণসমর্থন পায়নি। আজ বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার এ রকম বললে প্রচুর সমর্থন পাবে।’ ক্রিকেট দলের নির্বাচক কমিটির দুজনই সাবেক অধিনায়ক। বর্তমান ক্রিকেটাররা কেউ তাঁদের ‘ভাঁড়’ বলুক , এমনটা কেউই চান না। আমাদের নির্বাচকেরা বরং নির্বাচক শব্দটার সঠিক প্রয়োগ করে দেখাবেন, সেটাই আমাদের চাওয়া।
বাংলাদেশ দল:
সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন, লিটন দাস, আফিফ হোসেন, তাইজুল ইসলাম, রুবেল হোসেন, শফিউল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, সাইফউদ্দীন, নাঈম শেখ, আমিনুল বিপ্লব ও নাজমুল হোসেন শান্ত। সৌজন্যে : প্রথম আলো