সম্প্রতি নিউইয়র্কের অভিবাসী সমাবেশে প্রয়াত খান আতাকে ‘রাজাকার’ মন্তব্য করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তা নিয়ে এখনো দেশের শোবিজ অঙ্গনে আলোচনার ঝড় বইছে। তিনি বলেছেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এটাতো নেগেটিভ ছবি। মুক্তিযোদ্ধাদের বলছে আবার তোরা মানুষ হ। আরে তুই মানুষ হ’। ওই অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লাকেও হেয় প্রতিপন্ন করেন তিনি। তিনি আরো বলেছেন, খান আতা রাজাকার, আমি না হলে খান আতা বাঁচতো না। আমি না হলে খান আতা ৭১-এ ১৬ ডিসেম্বরের পরে মারা যায়। সে আবার মুক্তিযোদ্ধাদের বলছে আবার তোরা মানুষ হ। আরে তুই মানুষ হ, তোকে মানুষ হতে হবে। তার দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধা ও বরেণ্য অভিনেতা ফারুক বলেছেন, ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেক্ষাপট নির্ভর একটি ঐতিহাসিক সেলুলয়েডের দলিল। মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী অবস্থার আলোকে এটি নির্মিত। অথচ তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে যে মন্তব্য নাসিরুদ্দিন ইউসূফ বাচ্চু করেছেন তাতে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার চেতনার মূলে আঘাত করেছেন।

চিত্রনায়ক ফারুক প্রশ্ন রেখে বলেন, এমন একজন গুণী লোক। কল্পনাও করা যায় না। এদেশের বিখ্যাত যারা তাদের স্নেহধন্য কাছের লোক ছিলেন তিনি। যার ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’ ছবি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে। মাতৃভাষা বাংলা আন্দোলন ও স্বতন্ত্র দেশের চেতনা ছিল যার অস্থিমজ্জায়। তিনি আর কেউ নন দেশের বিরলতম গুণীদের অন্যতম খান আতাউর রহমান। তিনি বলেন, যার ক্যারিশমাটিক কর্মগুণের কারণে সে সময়ের বিখ্যাত পরিচালক এ জে কারদার তাকে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দেন। পাশাপাশি তাকে ক্ষমতা দেওয়া হয় বুদ্ধিদীপ্ত তরুণদের সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে। তিনি সে অনুযায়ী জহির রায়হানের মতো টগবগে তরুণকে সুযোগের ব্যবস্থা করেন। যিনি পরবর্তীতে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি দিকপাল হিসেবে আবির্ভূত হন। এগুলো ছিল সব ধারাবাহিক কাজের ফসল। এরপর আমরা জহির রায়হান, আমজাদ হোসেন (রচয়িতা) এবং খান আতা(অভিনয় এবং সুরকার) এই ত্রিফলার অমরসৃষ্টি ‘জীবন থেকে নেয়া’ দেখেছি। যার প্রতিফলন আমরা দেখেছি স্বাধীনতা যুদ্ধে। এটা সেলুলয়েড। পাশাপাশি ক্যামেরার পেছনে তাদের স্বদেশচেতনার প্রতিচ্ছবিও জাতি দেখেছে যা ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তারা তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিজেদের ইতিহাস রচনা করেছেন। যা আজও দেশবাসী শ্রদ্ধাবনত মাথায় স্মরণ করে।

সেই ত্রিফলার একজন খান আতাউর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্মাণ করলেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’। এটি নিছক কোনো ছবি ছিল না। যুদ্ধপরবর্তী বিশৃঙ্খলা নিয়েই ‘আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্র। এখানে দেখা যায় একদল সৎ মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের চোখের সামনে কিছু নামধারী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যায় লুটতরাজ, সহ্য করতে না পেরে ক্ষুদ্ধ হয়ে তারা নিজেরাও শুরু করে দেয় একই কাজ! কিন্তু তাদের কলেজের অধ্যক্ষ এটা মেনে নিতে পারেন না, তিনি তাদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করে তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু তারা সে কথা মানে না। এদিকে অধ্যক্ষর এক ছেলে এক মুক্তিযোদ্ধার বোনের সঙ্গে ভালোবাসার নামে প্রতারণা করে। ফলে বিয়ের আসরে মুক্তিযোদ্ধার গুলিতে সে প্রাণ হারায়, অপরদিকে অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্য মেয়েটিও আত্মহত্যা করে। অধ্যক্ষ নিজেকে পুত্রের হত্যাকারী বলে ঘোষণা করে সব অপরাধের ভার আপন কাঁধে তুলে নেন এবং পুলিশের কাছে ধরা দেন। পুলিশের সঙ্গে জেলে যাওয়ার সময় অধ্যক্ষ তার স্ত্রীকে বলেন, ‘তুমি এক ছেলে হারিয়েছ কিন্তু তোমার সাত ছেলে (মুক্তিযোদ্ধাদের দেখিয়ে) রেখে গেলাম’।

সময়টা বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল। তার সময় মুক্তি পেয়েছে। স্বভাবতই তার সায় ছিল। এখানে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সাহেব যে ভাষায় যেভাবে এমন একজন গুণীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন তার প্রতিবাদের ভাষা আমার জানা নেই। এতে কেবল উনি খান আতাকে অপমান করেননি করেছেন পুরো মুক্তিযোদ্ধাদের। কারণ ওই ছবিতে সবাই ছিলাম আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা দেশ গঠনে মনোনিবেশ হতে একাত্ম হয়েছি বলেই সেদিন সে ছবিতে মনপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছি। চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বায়ক ফারুক বলেন, সে সময় যে প্রেক্ষাপট ছিল সেটা যেমন আপনি (বাচ্চু) জানেন তেমনি আমরাও জানি। ছবিতে এতোদিন পর কি এমন পেলেন যে এটাকে নেগেটিভ মনে হল আপনার? তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আপনিও করেছেন আমরাও করেছি। তার মানে এই নয় যে আপনার কাছ থেকে জানতে হবে কে যোদ্ধা আর কে রাজাকার। যদি তাই হয় তবে নিজেকে পন্ডিত বলে জাহির করতে চাওয়া মি. বাচ্চু আপনিই বলেন, কি কি কারণে কোন কোন পরিস্থিতিতে রাজাকার বলা যায়। খান আতার তেমন কি জানা আছে আপনার, সেটা প্রকাশ করুন। নইলে মুক্তিযোদ্ধারা এর উপযুক্ত জবাব দেবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn